কবিতা নিয়ে বিতর্ক হলে কিছু ভালো তার্কিকের
সৃষ্টি হয়।তার্কিকের কবিতা নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। থাকেও না। সে
যুক্তির জাল বুনতে থাকে,যখন এ সব পড়ি মনে হয়, পৃথিবী এক ফুরন্ত ডোরবেল,কত যে
বিস্ময়!
কবিতার সঙ্গে তত্ত্বর স্ববিরোধীতা রয়েছে।
তত্ত্ব কবিতা নয়। কবিতাধারাগুলি দেখলে বোঝা যায়, কবিতা আগে লেখা হয়েছে,তত্ত্বর
সমর্থন এসেছে পরে। বাংলা কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়।‘নতুন কবিতা’র যাবতীয় চিহ্ন লিখতে
লিখতে ফুটে উঠেছে।সাম্নে এসেছে কবিতার নতুন ভাবনাগুলি। এই স্তরে যেমন প্রচুর কবিতা
লেখা হয়েছে সেরকমই রয়েছে এই নতুন কবিতাধারণার
ভাবনা নিয়ে লেখা অনেকগুলো গদ্যর বই যা এই কবিতাধারাকে প্রচল রেখেছে। এই
ধারা বা যে কোন ধারার যাঁরা বিরোধীতা করবেন তাঁদের বিরোধ তখনই ব্যক্তিগত
অসূয়া,উচ্চাশাকে অতিক্রম করবে যখন তাঁরা তাঁদের কবিতা ভাবনাকে কবিতা এবং গদ্যে
প্রভূত পরিমাণে বইয়ের আকারে নিয়ে আসবেন, নইলে যতই ক্লিশে বলুন বা অন্যকিছু এ সব
উক্তিকে ব্যক্তিগত হতাশার উচ্চারণ বলেই মনে হবে!
কোথাও তো যাবে সুশ্রী আরম্ভ হওয়া বিকেল,এক
পেগ পৌরসময়...কোথাও তো যাবে কবিতা, এই যাওয়াটা কেউ কেউ তত্ত্বে ফেলে দিয়ে বলেন এ
তো প্রকৃতি,এ তো নিসর্গ! নিসর্গ নিয়ে যা লেখার সে সব তো লেখা হয়ে গেছে। আর লিখেছে
কারা? সাহেবরা! এর পরেও নিসর্গ নিয়ে তৃতীয়
বিশ্বের কোন কবি লিখবে কেন?
তবু মেঘদূত! যখন সাহেবরা বর্বর ছিল! ভাবুন
সে সময়টা,কিন্তু মহান সাহেব কবিরা মেঘদূত পড়ে থেমে যাননি!
উদাহরণও দেয়া যাকঃ
1.
‘Then a mile of warm sea – scented beach;
Three fields to cross till a
farm appears;
A tap at the pane, the quick
sharp scratch
And blue spurt of a lighted match,
And a voice less loud,thro’its joys and
fears,
Than the two hearts beating each to each!’
(Robert Browning/meeting
at night)
2.
‘O rose,
thou art sick!
The
invisible worm
That flies in the night,
In the howling storm
Has found
out thy bed
Of
crimson joy;
And his
dark secret love
Does thy
lite destroy.
(Willium
Blake/The sick Rose)
নিসর্গ এ রকম দেখার
প্রতিক্রিয়াতেই বিভিন্ন হয়ে ওঠে।যার মধ্যে প্রকৃতি নেই,রোমান্স নেই, কল্পনা
নেই,অভিযান নেই সে কবি নয়। সে সফল ম্যানেজার,করণিক,অধ্যাপক, বাস্তুকার,ডাক্তার,খেলোয়াড়...সে
কবি নয়! যে কবিতাকে নিয়ে প্রজেক্ট বা সমবায় করতে চায়, সে ভালো সম্পাদক,ভালো
সংগঠক,সে পাগল নয়,সে কবিও নয়। যেমন বুদ্ধদেব বসু এবং জীবনানন্দ দাশ। প্রথমজন ভালো
সম্পাদক,দ্বিতীয়জন কবি!
কবি এক নিঃসঙ্গ রসিক
পাগল,যখন সে লেখে তখন,যখন ভাবে তখনো!এ পাগলামির কোন ওষুধও নেই। এর মূল চেতনায়,চেতনার
মূল বস্তুতে। বস্তুতে? এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্কে যাচ্ছিনা। বস্তুবাদ ওই নিসর্গ
রচণার মতোই ইওরোপের আগে ভারতে বিস্তার লাভ করেছিলো। গুরু বৃহস্পতির কথা মানে আছে
তো? চার্বাক সম্প্রদায়ের কথা? যাদের অধিকাংশ পুঁথিপত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিলো।
বিরোধীরা তাঁদের খণ্ডন করার জন্য যে সব চার্বাকী মতামত উল্লেখ করেছেন তাতেই আমাদের
বিস্মিত হতে হয়। আমি
এটাকেই ভারতীয়ত্ব বলি।
বেদ,বেদান্ত,উপনিষদ থেকে ভারতীয় বস্তুবাদ অন্যদিকে অত্যন্ত ধনী ভারতীয় কথাসাহিত্য
এবং কাব্যসাহিত্য এ তো আমাদের উত্তরাধিকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের মনের জানালা হামেশাই
বন্ধ থাকে। আমরা ধরেই নেই কবিতা লিখতে গেলে পশ্চিমই হলো benchmark!
আমার মনে হয়
রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। অনেকেই সে সময়ের বিখ্যাত এবং নিঃসন্দেহে কালজয়ী
কবিদের কথা উল্লেখ করে বলেন যে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক সময়ের ব্যক্তিমানুষের যে সঙ্কট
তাকে বুঝতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ যে এ সব বোঝেন নি তা এঁরা বুঝে গেছেন! কি
বুদ্ধি! একজন বাংলা ব্যান্ডের গায়ক বা লিখিয়ে একটি চ্যানেলে তো বলেই ফেললেন যে, র্যাবোঁ
থেকে এলিয়ট এ যদি হয় আধুনিকতা সেখানে রবীন্দ্রনাথ কোথায়? বাংলা ব্যান্ডের সমস্যা
কিন্তু অধিকাংশ কলা সমালোচকদের চেয়ে আলাদা নয়। এঁরা অর্থবোধক গান লিখে গেয়ে
থাকেন,অর্থহীনতায় এঁরা অসহায়! ফলতঃ রবীন্দ্রনাথকে একটা অর্থময় পরিসরে বেঁধে ফেলা
না অবধি এঁদের স্বস্তি নেই। আমার তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ নিজের স্বাতন্ত্র বজায়
রাখার জন্য ভারতীয় অসীম ভাবনায় নিজের কবিতাটি লিখে গেছেন। এই মৌলিকতাই প্রায়োগিক
মৌলিকতা। কিছু আছেন যাঁরা মৌলিক ব’লে কিছু হয় বিশ্বাস করেন না! এঁদের উচিৎ মৌল কণার যাঁরা খোঁজ করছেন তাঁদের সঙ্গে বিতর্ক
শুরু করা! কবির মৌলিকতা হলো প্রায়োগিক
মৌলিকতা! কবিতায় রতীয়ত্ব আনার চেষ্টা কিন্তু স্বভাবে না থাকলে হবে না। upstart কেউ ছুঁতেই
পারবে না এই মেজাজ! কবি বারীন ঘোষালের ‘সৎকার’ পড়ুন, যা বলতে চাইছি কিছুটা
পরিষ্কার হবে!
‘আমাদেরই নদীর চেয়ে
বড়ো অপেক্ষারা
আমাদেরই পিওন শুধু
হাঁটে যখন একটু আগে বৃষ্টি.....’
কিছু স্বঘোষিত বোদ্ধা
আছেন যাঁরা যে কোন কবিতাকেই একটা নাম না দিয়ে স্বস্তি পান না! উল্লেখিত কবিতাংশে
যেহেতু নদী আছে,বৃষ্টি আছে অতএব এ ‘প্রকৃতিরচণা’
না হয়ে যায়না! একটা নাম দেয়া হলো ‘প্রকৃতিরচণা’, নাম মানের দিকে আপসেই নিয়ে
যাবে।এ হলো পন্ডিতের স্বভাব।নামছাড়া সে অসহায়!
Brand name ছাড়াও!
এ ভাবেই চেতনার
অভিযানের অনিশ্চিত প্রণোদনাকে আনুভব করতে না পেরে,আনন্দটা Share করতে না পেরে ‘new-lyric’ ইত্যদি বলে
দেয়া হলো! একটা মজার কথা বলি,বিশুদ্ধ ভারতীয় মেজাজে অবশ্যই। আর মেজাজটাই তো আসল
রাজা! ‘শৈব-সিদ্ধান্ত’ দর্শন অনুযায়ি বুদ্ধির উৎস প্রকৃতি। মায়ার দুটি ভাগ। শুদ্ধ
মায়া,অশুদ্ধ মায়া।আবার এই অশুদ্ধ মায়া থেকে উদ্ভুত হয়েছে কাল,নিয়তি আর কলা। কলার
দুটি সন্তান : বিদ্যা এবং প্রকৃতি। প্রকৃতিই উৎস চিত্ত এবং বুদ্ধির! তো বুদ্ধি,পন্ডিতের
প্রবল বুদ্ধিও প্রকৃতির সন্তান! আমরাও। পন্ডিতমশাইদের অনুরোধ বুদ্ধির ধাত্রীদেবীকে
অবহেলা করবেন না!
নিসর্গ,প্রকৃতি জীবনের
বাইরে নয়! তবে ‘nature writing’ ইত্যাদি বলার পিছনে পন্ডিত- কবিদের দুষ্টুবুদ্ধিও ছিলো।‘নতুন কবিতা’কে খেলো
করার দুষ্টুবুদ্ধিও! উদ্দেশ্য এই যে, এরা নতুন কিছুই করেনি,‘nature writing’এর মধ্যে নতুন কি আছে? এই প্রশ্ন তুলে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিলো তাঁদের।এটা
ধোপে টেকেনি,কারণ যাঁরা এটা বলছেন তাঁদের নিজস্ব কবিতাধারার কোন আবাহন কোথাও ছিলনা।নিন্দার ওজন আছে তবে তা সৃষ্টির চেয়ে বেশি নয়। এ জন্যই বলা যে ‘নতুন কবিতা’র
বিরোধীতা যাঁরা করছেন তাঁদের আরো পরিশ্রমী হতে ।নতুন একদিন পুরনো হবে এটাই
স্বাভাবিক! আলো দেখা কেন হেরে যাবে আলো জ্বালানোর কাছে? কবিতা আলো দেখার অনুভবে নিয়ে
যায়। সে এক নন্যরূপ চেতনার বিচ্ছুরণ! আলোজ্বালানো একটা system এর অংশ। চেনাপথ,জানা
পথময়তা! কবির আনন্দ যদি অনুভবের বিমূর্ত থেকে না আসে তাহলে তিনি আলো জ্বালাবেন।
মানে খুঁজবেন। অন্ধকারের অচেতন তাঁর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে চিরকাল। নতুন
কবিতা কালের নিয়মে পুরণো হবে। লেখা হবে নতুনতর কবিতা। এই কবিতা তরুণ কবি ছাড়া কে
লিখবেন?
আমি এই গদ্যটি লিখে
ফেললাম তবে কি আলো জ্বালাবার অভিপ্রায়ে? হতে পারে। আমি তো কবি নই। সেই কবে থেকে
আমি তোমাদের বই কুড়িয়ে দিচ্ছি, কিছু করার নেই, আমার কুড়োনে স্বভাব! হয়তো কোন
অমূল্যরতনও এভাবেই একদিন.....