67Th pOsT : রমিত দে


আনন্দ যাত্রা


আনন্দে পাগলের মত লাগছিল ।তাকিকুওয়ার সেই দু শুঁড়ওয়ালা পাইন গাছটাকে খুঁজে পেতেই মনে হল এই তো সেই ঐশী অরন্যবৃক্ষ এই তো সেই চিরায়ত আশ্রয় যাকে খুঁজে না পেয়ে র্ধ্মসাধক নোইন মনকষ্টে ভেঙে পড়েছিলেন; তাও তো বোধহয় হাজার খানেক বছর হবে! হাজার বছর পরে বাশো কি হাজার বছর আগের পাইন গাছটিকেই খুঁজে পেলেন নাকি বীজধর্মের কাছে এসে এ এক ঐশ্বর্যময় অভিজ্ঞতা! সবুজের খোঁজে এসে সবুজের ভেতরই কি নতুন করে জন্মানো! উপলব্ধিটাই সেখানে আত্মপ্রতিকৃতি! অনুসন্ধিৎসু কবি আসলে গাছের খোঁজে এসে গাছের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন, গাছ থেকে আলাদা করে দিতে চাননি অরণ্যের আবহসংগীত; একটি পাইন গাছ, যাতে তত্ত্বের নামগন্ধ নেই যাকে শব্দচয়নে ধরা নেই তবু কালি রং ঢেলে কবি তাকে খুঁজে চলেছেন বারবার,কেবল এক ফর্মাল এসেন্স এক এমবডিড আইডিয়া নিয়ে এক অমর মাতাল খুঁজে চলেছে তার বিশুদ্ধ দ্রাক্ষাপুঞ্জটুকু- আর বারবার পূর্ণনির্মানে অমরত্ব পেয়ে যাচ্ছে মাননিক অন্তঃস্বরের ঠিকানা; গাছের মত কেবল এক মৌলিকতা , এক ধারনা, এক এক্সিশটেনশিয়াল ডায়ালেকটিক যাকে ঘিরে রয়ে গেছে কেবল কিছু পূর্ববর্তী নির্যাস,একাকী উদ্যানে ঢুকে পড়ার প্রকৃত পথ আর এই কালেক্টিভ পারসেপশন থেকে কবি ঢুকে আসছে ক্রমে সেই অমৃত ফলের কাছাকাছি ,তার অহংকার তীব্র হচ্ছে , এক নিটোল শূন্যের অহংকার যার ভেতর দিয়েই খুঁজে চলেছেন সেই অভিজ্ঞাতজাত অরণ্যের ছায়াগুলি, এ কোন সমতা নয় সামঞ্জস্য নয় অথচ একে ঘিরেই শিল্পীর আনন্দমন্দির,যাকে নিষ্ক্রমন করতে চাইছে না শিল্পী; ব্যক্তিগত আলোগুলোকে পুড়িয়ে দিয়ে তৈরী করছে ছায়া, এক অনন্য দহন, মাত্র কিছু সত্যতার জন্য এই দহন এই দর্পন-মাত্র কিছু পূর্ণতার জন্য মাত্র কিছু উপলব্ধির জন্য; অথচ একে নিয়েই নীহারিকাবাসি কবি একে নিয়েই নবরসে কবি;

 ক্রমাগত স্বপ্নের অনুসন্ধান করতে করতে শেষ অবধি ১৬৮৯ এ দীর্ঘ ভ্রমনের শেষে জাপানী কবি বাশো সেই পাইন গাছটির কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন,হাজার হাজার বছর আগের তাঁর পূর্বতন কবিদের রচনায় যে পাইন গাছটির কথা ছিল; এতসব বলার একটাই কারন নাগালের মধ্যে এই গাছ অবদি আমাদের কথা, এই দেহনির্ভর শিল্প অবধি আমরা জানি, আমাদের সাধারনতা আমাদের সামান্যতা  রেওয়াজ করছে ঠিক এমনই এক রসায়নে যা নিটোল যা গাঁথা আছে মূল কয়েকটি বিষয়বস্তুতে কিন্তু এ পর্যন্ত তো শিল্পের এক ছটাক মাত্র,কবিও কি ঠিক এই একটুকরো নিয়েই তার জন্মভূমি আঁকেন!অথবা চিত্রশিল্পী- তার রেখাগুলিও কি  কেবল  পরিনত রংগুলির ওজন আর সচেতন শিরদাঁড়ার ভেতরই খুঁজে ফেরে তার নিঃসঙ্গ বিশ্বাস! তার ফেরারি ভূবন! নাকি এই অবকাশের ভেতর দিয়েই শুরু হয় অন্তর্বতী পংক্তি নিয়ে অতীন্দ্রিয় পুল পেরোনো! তার স্মৃতির ভেতর রয়ে যায় মার্গসংগীতের মসৃণতা,শুরু হয় নাগালের বাইরে যাওয়া, স্বেচ্ছাকৃত ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সেই শেষ খণ্ডটিকে অতিক্রম করা!ছবি শুকিয়ে গেলেও তার রঙের নেটিভিটিগুলো জলীয়তাগুলো কোথাও খুঁজতে থাকে এই স্পিরিচ্যুয়াল ডায়মেনশন ,সেই মাস্টারস অফ মেনি-কে; শব্দ,সে অভিজ্ঞতা নির্ভর,অর্থাৎ  প্রেরনার প্রয়োজনে প্রমানের প্রয়োজনে কোথাও সে পূর্বনির্ধারিত, ইমপ্ল্যান্টেড, তার চেহারার বর্ণনা হয়েই আছে , তার শারীরপ্রদেশ তার সুষুন্মাশীর্ষ তাদের কোনো পরিশ্রম নেই তাড়না নেই হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি নেই বিস্মৃতি নেই ; সে অনায়াস প্রয়াসের;হরাইজন্টাল; কবির প্রকাশউন্মুখ বুনো হাঁসটি কেবল এই শব্দের অনুক্ষন নিয়ে উড়ে চলে গেছে। তার স্মৃতি তার জৈবিক শেকড়কে ছিঁড়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফিরে গেছে প্রিমরডিয়াল রাপচারের দিকে; এখান থেকেই কবি নিজেকে নির্মান করছেন, জীবনবোধের মরশুম থেকে প্রতিপালিত করছেন তার অপ্রকাশিত ল্যাণ্ডস্কেপ, ক্রমাগত এক প্রসারিত আত্তীকরন অথচ যাত্রা শেষ হয়না, অবিচ্ছেদ্য তন্ত্রের মত আত্মসাৎ করতে থাকে নিজেকেই

যাত্রার উপান্ত্যপর্বে এসে সমসাময়িক কবি কাইহাকুকে তার যাত্রার অনুভূতি জানিয়ে,পাইন গাছটিকে খুঁজে পাওয়ার অকল্পন বিস্ময় নিয়ে বাশো লিখেছিলেন- Three month after we saw/Cherry blossoms Together/I came to see the glorious/Twin trunks of the pine-সেমূর্হুতে   বাশোকে কি ঠিক কবি বলা যায়! নাকি  আরণ্যক!গাছের কাহিনি থেকে উর্ত্তীণ হতে হতে তিনি তো পৌঁছে গেলেন সেই গাছ উপজাত অমর ভাষার কাছে সেই অবিদিত চিত্রের কাছে যেখানে উড়ে চলেছে কথ্যশব্দ, উড়ে চলেছে নিরন্তর শিল্পী ও শিল্পের,যাত্রী ও যাত্রার দেহসংলগ্ন আনন্দকে আকাঙ্খা করে। যে পাইন গাছটিকে কেটে ফেলা হয়েছিল বারবার; যা বারবার নিজস্ব অবস্থায় না থেকেও অকর্ষিত ছিল, হাজার হাজার বছর পরেও ঠিক সেখানেই পোঁছেছিলেন বাশো।কারন তার মাটিতে সবটাই জৈব সার সবটাই টলটলে জল; নেভানো আলোর নিচে বসন্ত অবধি ঘুমানো ছায়ার সুলুকসন্ধান।তিনি ছবি আঁকতে আসেননি অথচ তার শব্দে রয়ে গেছে ন্যাচারাল সাইন, রয়ে গেছে দৃশ্যের স্টিমুলাই আর ঠিক সেখান থেকেই তার সমস্ত চলাই আসলে সেই পূর্বজ প্রথম চূড়োতে পৌঁছনোর চলা; এই দেখা- শোনা-পাওয়া আসলে পসরার ফাঁক গলে মাটির সাবালকত্বে লুকিয়ে পড়া সেই আদিম গাঁটি কচুটাকে পাওয়ার মতই,অব্যক্ত সংলাপ নিয়ে লকলকিয়ে উঠছে যার শেকড় একটু অন্ধকারের জন্য, আরও একটু গভীরে আক্রান্ত হওয়ার জন্য, যা আসলে প্রতীকবাদী অ্যাসিমেট্রির জন্য হয়ে আছে; বহিরাগতের মত অর্থহীনতার হয়ে আছে অথচ বিশুদ্ধতার ভরপুর জীবন কাটিয়ে আছে;এই খুঁজে পাওয়ার ভেতরে কোথাও শিল্পের প্রাকৃতিক বীজটাই ছড়িয়ে রাখা, সাজিয়ে রাখা মগ্নচৈতন্যপ্রবাহে ভেসে বেড়ানো শিল্পিত ফসল তোলার খেলা; শিল্পীর যে প্রাকৃতিক কৃষি যে নিজস্ব খামারবাড়ি তারই ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে মোম জ্বালিয়েছেন তিনি,আনন্দশরীর জ্বালিয়েছেন; নিরুদ্দেশ যাত্রায় বার বার প্রশ্ন করেছেন কেউ আছে ! কেউ আছে! এই প্রথম মাটিতে প্রধানা হয়ে কোনো স্থিরতা কোনো স্থবিরতা কি সত্যিই আছে? বাশোর এই ন্যাচারাল সাইনকে সংকেতকে কেন্দ্র করে করে শব্দ ও দৃশ্যের মধ্যবর্তী ওরিয়েন্টাল ভ্যাকুইমে পৌঁছনো আসলে এক দৃশ্যপ্রতীক যেখানে গাছ একটি শব্দ গাছ একটি বর্ণ গাছ একটি রং গাছ একটি বীক্ষা মাত্র,আসলে তার ব্যঞ্জনা কতদূর অবধি গিয়েছে তাই যেন কবির কাছে তার ছবির গল্প কিংবা চিত্রকরের কাছে তার গল্পের ছবি, ঠিক এখান থেকেই শিল্পী হয়ে উঠছেন দ্রষ্টা , পৌঁছতে চাইছেন স্বয়ম্ভূতে,আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন সেই কবিতার সংগীত কে অথবা দৃশ্যের লিরিসিজমকে ।শিল্পতত্ত্বের এই ঐকতান বা ট্রানজিশনল ডায়ালগ কোথাও ব্যক্তিগত ছায়া পেরিয়ে অবলোকিত নেটওর্য়াকে অনুভূত হতে চাইছে চরম আউটসাইডার হয়ে, বায়াসমুক্ত হয়ে;

বাশো যেন জানতেনই গাছ ছিল,বিশুদ্ধভাবে গাছ ছিল,শুধু এটকুই যেন এক কবির বিশ্বাস,লিপ অফ ফেথ; এক দ্রষ্টার দর্শন আর প্রতীকের এই অরণ্য পেরিয়ে হাজার বছর পরেও যেন তিনি ফিরে এসেছেন এই বিশ্বাসের কাছাকাছি; আমি থেকে বেরিয়ে এই যে আহ্লাদে অভ্যস্ত হওয়া , এই যে বার বার নিজেকেই উর্ত্তীর্ণ করা , নিজেকেই বলা বপন কোরোনা কেবল ছড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতিটুকু জানিয়ে দাও,বীজ থেকে গাছ নয় বরং বনাঞ্চলের সম্পূর্ণ জ্যামিতিতেই বোধিস্বত্ত্ব দাও এই হয়ত বারবার ফিরে আসা শিল্পের সত্যতার কাছে নিরাসক্তির কাছে; ব্যোদলেয়ার যখন লেখেন-অদৃশ্যকে দেখতে হবে, অশ্রুতকে শুনতে হবে; ইন্দ্রিয়সমূহের বিপুল ও সচেতন বিপর্যয় সাধনের দ্বারা পৌঁছতে হবে অজানায়; জানতে হবে প্রেমের, দুঃখের, উন্মাদনার সবগুলি  প্রকরণ; খুঁজতে হবে নিজেকে,সব গরল আত্মসাৎ করে নিতে হবে;( অনুবাদ বুদ্ধদেব বসু-ক্লেদেজ কুসুম-শার্ল বোদলেয়ার তার কবিতা), তখন সহজেই অনুধাবন করা যায় এই দু পংক্তির আমি টাকে পেরিয়ে যাওয়াই কবির মুক্তি শিল্পীর মুক্তি তার নিশ্চিত একফালি কে ভেস্তে দেওয়া ,আস্থা রাখা চোরাবালিতে , আসলে কবির অভিপ্রেত আত্মপ্রতিকৃতি ভাঙা আর সুস্থ হওয়া ;তার কাছে সবই চূড়ান্ত অথচ চূড়ান্ত বলে কিছু নেই, চূড়ান্তের আকাঙ্খাটাই মুখ্য;দূরবিসারী অপস্রিয়মানকে ধাওয়া করতে করতে জলবাতাস পাথরের প্লেটগুলোকে সরিয়ে সরিয়ে দিয়ে দেখে রাখছে কোথায় রাখা আছে যোগাযোগের পাণ্ডুলিপি, সেই অভাবনীয় উত্তরণ, সেই দ্বিতীয় পৃথিবীর ভাঙা দরজাটা-পোড়ো বাড়িটা! সতেরো শতকের এই ভ্রমনের নায়ক একজন কবি যিনি তার প্রাচীন কবিদের ছেড়ে আসা পাইন গাছটিকে খুঁজে পেয়েছিলেন দীর্ঘ পর্যটনের শেষে; বাশোর এই পর্যটন কে কনটেম্পরারি ট্যুরিজমের সাথে তুলনা করলে পৌঁছনো যাবে না পরিধিপ্রান্তে; বরং এ যেন টাইমলেস রিপিটেশন অফ আর্চিটাইপ অফ ভয়েজ; লতিয়ে লতিয়ে বেড়ে ওঠা সেই মায়া সাঁতার। ছিটকে যাওয়া, সিন্থেথিস হতে চাওয়া, আনন্দের বাইরের অনুধাবনে যেতে রাজী হওয়া; এখানে দৃশ্য নেই,দৃশ্যের স্বত্ত্বা নেই কেবল এক ট্যুরিস্ট গেজ, যা  সময়ের সম্ভাবনার কথা বলছে, যেন বলছে থেমে যাবে কেন! যাও, ভেসে যাও ; যা কিছু মর্মবস্তু তা তো বস্তুহীনতারই আদল,ত্বরনের ছাড়প্ত্র, হরাইজানটাল থিংকিং, দৃশ্যকে বাজিয়ে বাজিয়ে ভাসাকে পেড়ে ফেলার প্রীতি;এক ইনডিভিসেবল ভেলায় চড়ে ক্রমাগত কবির নিজেকে দুহাতে নিজস্ব করা। হাজার বছর পরেও বাশো সেই পাইন গাছের কাছে আসলে এক প্রতিবিশ্বকেই প্রস্তাব করেছেন, পূর্বাপরের ছেড়ে যাওয়া বিবৃতি ও চিত্রনের আদলে মিশিয়ে দিতে চেয়েছন স্ব অস্তিত্ব স্ব মহিমা; গাছ নয়,গাছের আদলে খুঁজে পেতে চেয়েছেন সেই সেরিমনিয়াল স্পিরিট অফ ট্রি; আর তা পেতে তাকে এক্সপ্লোর করতে হয়েছে কিছু দৃশ্যগত ভার্টিকাল কনফর্মিটি; শিল্প যেন এমনই এক পর্যটকের চাওয়া, যে তার গাইডবুকের আবহপ্রবাহবীজরেখারং সম্বল করে ক্রমাগত ঢুকে পড়ছে কাচঘরের দেওয়াল ভেঙে, ঢুকে পড়ছে দৃশ্যের বিকার পেরিয়ে, দূরান্বিত  জীবনের মত উষ্ণ আর্দ্র কাঞ্চনমালার কাছে এসে শুনতে চাইছে প্রবংশের পদক্ষেপ। গাছ লতা গুল্ম আগাছা দিয়ে এমনই প্রাকৃতিক অ্যালকেমিতে ভরা শিল্পীর দপ্তর, তার পোশাক ভিখারির মত কারন ভিক্ষা ছাড়া সবুজ অন্ধকারে তার আর কোন সজ্ঞান শিল্পচর্চা নেই ;কেবলই এক ভিজিবল পাইন গাছকে ছোঁওয়ার তাগিদে নয়, কেবলই এক উদ্দীপক ইতিহাসের সাক্ষী হতেও বোধহয় না , ইউনিফায়েড অনুরননকে ধরতেই-সংক্রমণের সেমিওটিক্সকে আঙুলের অলীক করতেই কোথাও যেন বাশো খুলে বসেছেন এক বৌদ্ধিক বৃত্ত  , ঠিক যেভাবে সমুদ্র ভ্রমনের শেষে কোলরিজ লিখতে চেয়েছিলেন নাবিকের গান,সেই অকূলবিস্তীর্ণ গায়কির প্রান্ত কিংবা গঁগ্যা তাঁর হলুদ যীশুর মধ্য দিয়ে সুযোগ করে দিলেন বিন্দুসত্যের প্রবেশপথের! ছায়াপ্রচ্ছদের! আসলে খড় দিয়ে ঢাকা থাকে অন্তরালগুলো আর হিম হিম রোদ্দুর এলেই শিল্পীর দ্বিতীয় স্বত্ত্বা ভেসে যেতে থাকে ফ্রেইগেইন্স অফ ইসথেটিক প্রেজেন্সের দিকে; সীমাসর্তক শিল্পী  কিন্তু এই স্বকীয় থাকার সম্ভাবনা  মনভূমি অবধি টানতে পারবেন না ফলত ছুটিও নিতে পারবেন না স্নেহগ্রন্থি থেকে, পরিত্যক্ত হতে পারবেন না আরম্ভের অসহায়তা থেকে; এ কেবল উদাসীন চিত্রকরের-  যে মধ্যবর্তী শূন্যতাতেই সুতা ছিঁড়ে রেখেছে তার সতেজ শিরদাঁড়ার,যেখানে দৃশ্য কেবলমাত্র কিছু বিস্তৃত বিবরন মাত্র, তার আরম্ভ এবং শেষ -তার রোদ এবং বাতাস -তার পচা বৃষ্টি ও থিকথিকে কাদায় জলবন্দী গ্রাম নয় বরং মানচিত্রের ওপাশের খণ্ডিত সত্যকে, সমগ্রতাকে উচ্চারিত করছে; Things are read as signs of themselves. A place, a gesture, a use of language are understood not as given bits of the real but as suffused with ideality, giving on to the type of the beautiful, or the extraordinary, or the culturally authentic. Their reality is figural rather than literal….



ঠিক একইভাবে সচেতন বিশ্বজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিলেন পল গঁগ্যাও,ভেসে যেতে চেয়েছিলেন স্থুল জাগ্রত গসপেল থেকে প্রথম পললে,তার অনুসন্ধানও আসলে পূর্ননবীকরনের প্রত্যাশায়; অবয়বনির্ভর রেখা থেকে বিরেখায় ফেরা, আনসিন কোহেরেন্সে ,আদিম আত্মিকতায়; নিরেট রঙের থেকে এও কী সেই ব্যক্তিগত হায়ারোগ্লিফের আবিষ্কার নয়? যেখানে রূপ থেকে স্বরূপে মুক্তি চেয়ে নিয়েছে শিল্পী,উৎসারিত আলোর থেকে অন্ধকারের প্রহরী হয়ে এ এক অসামান্য চিত্রিয় সংহতি; শিল্পীর বাঁচা বেঁচে থাকা সে তো প্রকৃতির অলিন্দে পাতাকুড়ানি হয়েই,তার আঁকাআঁকিগুলো -সংরক্ষনগুলো তো নৈশযাত্রীদের পেছনে রেখেই ফিরবে সেই প্রস্তুতিপর্বের রহস্যময় ভাষার কাছাকাছি , যেখানে মর্ম হাড়ের ভেতর জড়িয়ে রয়েছে সেই অবস্কিয়র সেলফ সেই অর্বণনীয় শূন্যতা , প্রত্যক্ষ করিড়র দিয়ে সে ছুটে চলেছে অণ্ডজ স্বরূপটি উদ্ধারে,ফিরে তাকাচ্ছে না; বন-মাঠ-গাছপালা-এই প্রতীকবাদী পৃথিবীর সবটুকু দখল রেখে কেবল নদীর ওপারের স্বরবর্ণটুকু দেখতে,নিজেকে নিজেই চুরমার করে সরলীকৃত করতেই কি গঁগ্যা ভেসে গেলেন না হাইতির দিকে? গো ব্যাক ট্যু দি ওরিজিন, টু হিউম্যানিটি ইন ইটস ইনফ্যানসি! কান পাতলেই কি শোনা যায়না তার এই নোভা ভয়েজ! আসলে কোনো থাকা নেই কিমবা কেউ দেখতে পাচ্ছে না পুরো না থাকাটা, জীবনকে আলিঙ্গন করার স্বতন্ত্র্য নির্মানটা !শৈশবের ইনকা স্মৃতি,পেরুভিয়ান রক্ত ,আদ্যন্ত নির্সগের প্ররোচনায় সেই প্রথম দৃশ্যের সরলতা খুঁজে পেতে গৃহবাসী জীবনে গঁগ্যাও হলেন  অনন্ত শ্রমন, স্ত্রী-সন্তানের কাছে ছেড়ে গেলেন তার গেরস্থালি তার তৈজস আর মিড়ভাঙা বন্দিশ নিয়ে ভ্রমণের বেসাতি নিয়ে ফিরলেন যাত্রার দিকে, প্রত্যাবর্তণের দিকে ; অঘোষিত অপরের দিকে; যেন জানতেন দৃশ্যমান জগতের বাইরের পূর্ণতা আর শূন্যতার অ্যানাটমি কেবল সম্ভব আনটেন্টেড পিওর প্রিমিটিভিজমে; যেখানে গাছে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছবির ভাষা-রঙের তরজমা;Don’t copy nature so closely. Art is an abstraction, as you dream amid nature, extrapolate art from it.” এই নেক্সট ট্যু নাথিং-ই শিল্পীর কাছে সেই সরল গণিত,পিতৃভূমির মাঝে পড়ে থাকা একখণ্ড আত্মীয়,স্মৃতিসংরক্ত মুনাফা; তার নির্বোধ পোশাক কি খোলা নেই এই উদাসীন মহোৎসবে! এক্ষেত্রেও শিল্পীর উদ্দেশ্য সেই বিশেষ আনন্দকে খোঁজা সেই প্রথম প্রসূতিসদনে,বেড়িয়ে পড়া প্রিমিটিভ প্যারাডাইস খুঁজতে,নোবেল স্যাভেজ হতে; তাহিতি আইল্যান্ড পরিভ্রমনকালে আঁকা তাহিতান নারী (Two tahitian women)তে শরীরের যে অনুরণন যে ন্যুড লাইন রেখে গেলেন গঁগ্যা তা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় কেবল দেহনির্ভর শিল্প যেমন আঁকতে চাননি চিত্রকর তেমনি কোন নকলের ফসলও তোলেনি রঙের ছলাকলা; বরং আবরনহীন শরীর পেরিয়ে খানিকটা জায়গা ছেড়ে গেছেন উর্বর সিল্যুটের জন্য;প্রাকৃতিক শস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানবীর উপস্থাপনার মাঝেই রেখে গেছেন জীবনের মহাপটে প্রবেশ্যতা; এক নান্দনিক অবয়ব এক বিরাট শাশ্বত প্রশ্ন;দীর্ঘ ভ্রমনকালের শেষে আলোছায়ার খেলা চিত্রশিল্পীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সেই বিচ্ছন্নতার সামনে সমগ্রতাকে জানবার তাগিদে, ছায়া ফেলছে তার শব্দহীনতায় তার চিত্ররূপে;আসলে স্রষ্টা বারবার অস্থির সেই দুর্লভ স্থিরতার দিকে,যে দূরাশ্রয়ী প্রবেশের জন্য নিকটের ফসল জড়ো করে রাখছেন তিনি, এখানে শিল্পীর কোন রং নেই তুলি নেই ক্যানভাস নেই কেবল বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমাগত নিঃস্ব হওয়ার- দেউলিয়া হওয়ার কোলাজ; কবিও কি এমনই এক গল্পকার  যিনি শীতের রাত্রে সত্য কারুকে দেখতে নিশ্চিদ্র পলায়নবৃত্তি গ্রহন করবেন শব্দ থেকে ! এক অন্তিম সৃজনের চেষ্টা করবেন বাচন সারল্যে! এ তো যাওয়া নয়-ফেরার এক অন্তিম রফা; অদৃশ্যকে দেখতে অশ্রুতকে শুনতে সেখানে তাকেও ফিরতে হবে সেই আদিম অভেদের পংক্তিতে;

পরম বীজের অঙ্কুরোদ্গম দেখতে যে উত্তর সাগর ধরে ধরে এগিয়ে গেলেন গঁগ্যা,সভ্যতার মার্জিনে দাঁড়িয়ে জর্জরিত হতে চাইলেন সুক্ষতম স্ব-এ,ঠিক সেখান থেকেই স্রষ্টার একমাত্র প্রতিপাদ্য সর্বময় অনুপস্থিতি,নাথিংগনেস,দৃশ্যমান জগতের থেকে অরূপে লীন হবার আর্তি নিয়ে ফিরে চলেছে এক একটি মূর্হুত; শিল্পীর অলিখিত জার্নালে এমনই এক পরিনত আয়না যা প্রতিফলন শেখাচ্ছে বারবার, বুঝতে শেখাচ্ছে অভাবগুলো, বিশুদ্ধ দেশের গানগুলো,নির্সগের মধ্যে দিয়ে নিয়ে চলেছে নির্সগহীনতায় আর এই মুগ্ধতা নিয়ে -প্রত্যাখ্যান নিয়ে কবি চিত্রকর শিল্পী দ্রষ্টা সরে সরে যাচ্ছে মহাজাগতিক পরিক্রমায়;একটিমাত্র বিশুদ্ধ শূন্যতাকে কেন্দ্র করেই দানা বাঁধতে থাকে তার এই ইন্দ্রিয় বিপর্যাস;অথচ তা নিরাকার নয়, জাগরণের মধ্যেই সে এক উল্লাসধ্বনি;আসলে চেতনা সে তো বস্তুকে বাচ্য করেই অথচ ভেতরের জায়গায় রেখেছে কেবল সম্ভাবনা, তার গতি অনির্দেশ্য, সে নিরাকার নয় জড়প্রকৃতির নয়,ফুল তুলতে তুলতেই বীজ পেতে চাইছে,বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দিয়েই গুনে গেঁথে চলেছে সমগ্রতা;দ্য বিংগস অফ কনসাসনেস ইজ দ্য সেলফ কনসাসনেশ,পৃথিবী-বস্তুজগত এই পারিভাষিক পরিমাপে অতীত ভবিষ্যৎ যা কিছু আছে তা কেবল দ্বিতীয়তার কারন এই অতীত বা ভবিষ্যতের ধারনা ব্যক্তির নিজস্ব,ব্যক্তির প্রাথমিক সমীকরনেরই অংশ; একজন আত্মপ্রত্যয়ী শিল্পী তার ইন্ট্রিগ্রেশনে এই ব্যক্তিক অতীত কে ভবিষ্যৎকেই ধরতে চায় তার বর্তমানের বস্তু সাদৃশ্যে, তাই পর্যবসিত হয়  তার চিন্তনে তার ছায়ার মগজ়ে আত্মঅতিক্রমন করতে চায় পরিক্রমার প্রানগুলো, পসিবিলিটিসগুলো; ১৮৮৯ এ গঁগ্যার সেলফ পোট্রের্ট ক্রিস্ট ইন দ্য গার্ডেন অফ ওলিভেও আমরা যেন শিল্পীর সেই নিজস্ব ভাষা সেই অন্তঃকৃতিকেই লক্ষ্য করি, ক্যানভাসের মধ্যে নেই অতিরিক্ত আলোড়ন অতিরিক্ত অস্থিরতা কেবল এক স্তব্ধতা কেবল রঙের চূড়ান্ততায় ব্যক্তি-বস্তু থেকে বিবর্জিত হওয়া , পৌঁছে যাওয়া ঘন ঘন আরও স্থির ঘনতায়; আসলে শিল্পী তার সারাউন্ডিংগ থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই উৎসের সানাই,সংশয়াছন্ন এক স্রষ্টা খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিপুল ভাষাহীন সেই মিস্টিক ল্যাংগুয়েজ সেই এলিমেন্টাল এন্ট্রান্স ,যে প্রশ্নের উত্তর শিল্পীই জানেন যে প্রশ্নের উত্তর হারিয়ে ফেলেছেন শিল্পীই, এক ধাঁধা যা আদতে ধ্যানমগ্নতা 



দৃশ্যের ভেতরই লুকিয়ে রয়েছে সাজেদার দৃশ্য, শব্দের ভেতরই লুকিয়ে রয়েছে শব্দের অধিক সর্মপণ; আলোর অধিক অপরিচিত; বিস্মৃত করছে মুগ্ধ করছে বিশ্বাস করছে অন্ধকার ছাড়া উত্তেজনা নেই,ছায়ার ভেতর নেই কোনো প্রতারনা-ছায়ার ভেতরই মহান প্রস্তাবনা, মহৎ শিল্পকে শুকোনোর জন্য মড়াই নয় সম্পূর্ন মাঠ ছাড়া আর কোনও অজুহাত নেই, এবং এই আবাদে কাঙাল তোমাকে বসে থাকতেই হবে, নিরন্তর নির্ভার নির্জন সাদা চাদর জড়িয়ে সেই অতিপ্রজতা নিয়ে সেই প্রথম নিয়ে;গুনগুনানি ঢুকবে,ছায়া করে আসবে আর সেই হবে দোলন, সিঁড়িঘর থেকে সন্তর্পণে শিল্পীর স্বপ্নসন্ধানে যাওয়ার একমাত্র সহযোগী, একা হওয়ার সেই একমাত্র সমীকরন;আসলে শিল্পীর কাছে শব্দদৃশ্যরং সবই আদতে মৌনরাসায়নিক সার ছাড়া কেবল ঘাসের জল্মি যা কিনা ফোটার চেয়ে একা যা কিনা মরশুমের আগেই মাখানো সেই মোম যার বয়স বাড়েনি যাকে মধু থেকে তুলতে পারেনি স্রষ্টা;সে কেবল আগন্তুক- অতিক্রম করতে পারছে না যাকে তার দিকেই দরজা খুলে রেখেছে খুলে রেখেছে নিঃশব্দ ধারাবাহিক যাতায়াত; বহুত্ব অপরস্বত্তা বোঝাতে কেবল এক ইনট্রা ডায়েজেটিক সাউণ্ড দুরস্তব্ধ হয়ে আছে যার কেন্দ্রকে আমরা খুঁজে পাচ্ছিনা অথচ সে আছে, আকুতি হয়েই ব্যক্তিমানসে বিচ্ছুরণ ঘটিয়েই সে আছে, শিল্পীর ভেতরেই কোথাও বহুদূর পর্যন্ত বর্ণমাতাল হয়ে রয়েছে এই স্টোন রাফট, এই ফ্র্যাগমেন্টটারি উপদ্বীপটি, যা বারবার একই জলের কথা শোনাচ্ছে,অথচ তা নির্ডাক অথচ তা নদীকেই লুন্ঠন করার কথাই বারবার বলছে;জাপানি কবি বাশোর পর্যটনের ভেতর রয়ে গেছে এই হাইপাররিয়াল অনুলিপি তৈরী করারই খেলা, মাটি থেকে উপমাটি কুড়োনোর এক সচেতন দুর্বলতা । কবির বৈকুন্ঠে গন্তব্যের প্রশ্ন নেই কেবল পর্যটনের নজর বা ট্যুরিস্ট গেজ আর সেখান থেকেই পেছন ফিরে পরিভাষা খোঁজার চেষ্টা;

বর্ণ এবং দৃশ্য এক আত্যন্তিক সহজ শব্দ অথচ প্রায়শই তার অনির্বায কেন্দ্রে পৌঁছতে পারছিনা আমরা,নাকি শব্দ-ছত্র-অনুভূতি অবধি পৌঁছতে চাইছিনা! কোথাও যেন খানিকটা ইন্টেলেকচ্যুয়াল এরর রেখে যাচ্ছি স্রষ্টার জন্য, খানিকটা দ্বিতীয় হার্মনি তার পরমূর্হুতের জন্য তার গাঢতর অন্বেষার জন্য, কোথাও যেন ওজন দরে বিক্রী হচ্ছেনা তনুভূত সহজ; আসলে দ্রষ্টা একজন পর্যটক আর তিনি তার সাজপোশাক অঙ্গরাগ সব কিছু ছেড়ে অনুগমন করছেন সেই ঐশী পর্যটনের ভেতর যা আমরা ছেড়ে আসছি পাইন গাছটির আদলে ছেড়ে আসছি উত্তর সাগরের ফেনার অনুপ্রবেশে; আর এরই মাঝে চেতনাকে আলাদা আলাদা করে চিনে নিচ্ছে স্রষ্টা,আনন্দিত করতে করতে মাটি থেকে ছেড়ে আসছে তার পা

বাশো তো আলো জ্বেলে সনাতন বৃক্ষ খোঁজেননি, অথবা গঁগ্যা সেই সরল দ্বীপের সন্ধান পেতে জলে নামেননি অথচ পেয়েছেন কারন তাদেঁর কাছে ছিল পরমে পৌঁছবার এক অনন্তস্পর্শী সম্ভাবনা, ব্যক্তিকে বর্জন করার প্রেরণা, স্রেফ ছায়ার দিকে টেনে নিয়েছেন আলো বা গাছের মূর্ত ধারনা গুলো স্ফীত নীল শিরাগুলো, ঠিক যেমন গঁগ্যা তার জলের আয়নায় নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন নৈর্ব্যক্তিক পরিমার্জনাগুলো জলের কাঁপনগুলো; কারন আলো, সে তো অন্ধকারের ধারনা ছাড়া আর কিছুই নয়, আর নয় বলেই চোখ তাকে অহরহ খুঁজছে পতঙ্গশিকারী ফুলের মত সত্য উন্মোচনের জন্য, অবধারিতকে জানার জন্য, প্রথম শিল্পে একাগ্র হওয়ার জন্য; কোথায় চলেছ? দ্রষ্টা যদি তার নিজস্ব প্রাণভোমরাকে এ প্রশ্ন করে তবে তার কাছে থেকে যায় কেবল এক অপ্রতিরোধ্য বর্জন অথবা অজ্ঞাতসারেই ফ্রেমবন্দী হয়ে পড়ে সেই বৃহত্তর অর্জন, মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্তকে পেরিয়ে যার ভ্রমন কেবল সেই সর্বোত্তম শব্দে সেই প্রাথমিক রঙে 



                                                ***********************