সেদিন রাতে অফিস থেকে সেই মাত্র বাড়ি ফিরেছি। প্রচণ্ড গরমে গলদ্ঘর্ম।
বিধ্বস্ত-প্রায় অবস্থা। বাথরুমে গায়ে জল ঢেলে বেরিয়ে টেবিল-ফ্যান চালিয়ে প্রাণপণে স্বাভাবিক
হবার চেষ্টা করছি। অনুপমের ফোনটা এল। বাকের পরের সংখ্যার জন্যে গদ্য লেখার অনুরোধ।
দেখা সাক্ষাতের বাইরে অনুপমের সঙ্গে আমার যেটুকু কথা হয়েছে সবই ফেসবুকে। ফোনালাপ
এই প্রথম। বলতে চাইলাম অফিসের এখন যা কাজের চাপ তা আমাকে প্রায় গিলে ফেলেছে।
লেখালিখির সময় একেবারে কমে গেছে। এখন কিছু লেখা বিশেষ করে গদ্য, প্রায় অসম্ভব। উত্তর
পেলাম এখনো প্রায় কুড়ি দিন বাকি আছে, তার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। নিমরাজি হয়ে বললাম দেখি চেষ্টা করে। ভাবছি কী নিয়ে
লেখা যায়, এক মিনিট কাটতে না কাটতেই আমার ফোন। কবিতা পাক্ষিক নিয়ে কিছু লিখুন।
প্রভাতদাও সেটা চাইছেন।
অতঃপর কলম ধরতেই হল। থুড়ি, এখন আর লেখালিখি করতে কাগজ কলমের দরকার পড়ে না। ল্যাপটপের স্ক্রিন ও
কি-বোর্ডই সম্বল।
আজ শনিবার। ছুতির দিন। কমপিউতার খুলে বসে ভাবছি কোথা থেকে শুরু
করি। আসলে আমার মতো একজন পার্টটাইম সাহিত্যকর্মী্র পক্ষে লেখালিখিটা সত্যিসত্যিই এক পরিপূর্ণ আয়াসসাধ্য ব্যাপার। সারাদিন তো কেটে যায়
সরকারি অফিসে গোমস্তাগিরি করে।বাড়িতে ফিরেও রেহাই নেই, মাঝে মাঝে অফিসকে পিছনে
বেঁধে আনতে হয়। তার উপর আছে চন্দনগর থেকে কোলকাতা প্রতিদিন নিত্যযাত্রার পরিশ্রম ও
ক্লান্তি। এরই মধ্যে লেখালিখির নতুন আইডিয়া মাথার মধ্যে উঁকিঝুকি মারলেও বেশির ভাগ
সময়েই তা দানা বাধতে পারে না। হারিয়ে যায়। এভাবে কত ভাবনা-চিন্তা যে মাঠে মারা যায়।
মনের মধ্যে তারা ফেলে রেখে যায় একরাশ বিষাদ ও শূন্যতা। তার সঙ্গে যোগ হয় চারপাশের
রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি থেকে ছুটে আসা অজস্র নৈরাশ্য, হতাশা ও নেতিবাচক
বার্তাগুলি।
বোধ হয় এভাবেই প্রতিদিনের ঘাতে-প্রতিঘাতে একটু একটু করে ফুরিয়ে
যেতে হয় মানুষকে। শরীরে ও মনে বড়ো হতে হতে কখন যেন মানুষ বুড়িয়ে যেতে থাকে। নতুনকে
ছুঁতে পারে না, বদলকে মেনে নিতে পারে না, নাগরিক জলহাওয়া থেকে পুষ্টি আরোহণ করেও
মানুষ হয়ে যায় গুহাবাসী।
তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, মানুষ বাঁচতে চায়। কারণ মানুষ
স্বপ্নজীবী। মানুষই একমাত্র জীব যে স্বপ্ন দেখতে জানে, স্বপ্ন দেখতে পারে। তাই সে
শেষ হয়েও শেষ হয় না। সে ফুরিয়ে গিয়েও ফুরোতে চায় না। তাকে বাঁচিয়ে রাখে তার
স্বপ্ন। তাকে বাঁচিয়ে রাখে তার আশা। তুচ্ছ বলে, দূরছাই করে, যাকে দূরে ফেলে দেওয়া
হয় জাদুকরী শক্তি নিয়ে সেও একদিন ফিরে আসতে পারে অফুরন্ত এই জীবনের উৎসবে।
আমার কাছে এই স্বপ্নেরই আরেক নাম কবিতা পাক্ষিক।
‘মানুষ
যতদিন পর্যন্ত স্বপ্ন দেখবে ততদিনই কবিতাপাক্ষিক’- এটা কবিতা পাক্ষিক-এর
ক্যাচ-লাইন। অন্যদের কাছে কথাটা হয়তো একটু বেশি রোম্যান্টিক শোনায়, তবু আমার কাছে
এটা একশো ভাগ খাঁটি। কারণ এই কবিতা পাক্ষিক নামক ব্যাপারটি আমার
শয়নে-স্বপনে-জাগরণে প্রায় শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই মিশে গেছে। সুপার স্বাভাবিক।
বাঙলা কবিতার অনুরাগীদের কাছে কবিতা পাক্ষিক তো একটা স্বপ্নই।
গত কুড়ি বছর ধরে প্রতি ১৪ দিন অন্তর নিয়মিত প্রকাশিত একটি অবাণিজ্যিক কবিতা
পত্রিকা। তার ৫০০-তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হতে চলেছে আগামী ১৭ নভেম্বর ২০১২। সারা
বিশ্বে এর কোনো তুলনা নেই। এটা অবশ্যই একটা ঘটনা। দুর্ঘটনাও বলা যায়। বিশ্বাস করতে
কষ্ট হয়। অথচ অবিশ্বাসেরও উপায় নেই। সুখে দুঃখে ভালোয় মন্দয় ঘৃণা বা ভালোবাসায়
কবিতা পাক্ষিকের এই পথচলাকে উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, না সমীহ করে স্যালুট
জানাবেন সেটা সুধী পাঠকই ভেবে দেখুন। আমি শুধু আমার উপলব্ধিগুলোই লিপিবদ্ধ করতে
পারি।
আলোচনার এই পর্বে কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতটি একটু
দেখে নেওয়া যাক।
‘কল্লোল’
থেকে ‘কবিতা’ হয়ে ‘কৃত্তিবাস’
বা ‘শতভিষা’ বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক একটা
মাইলস্টোনের নাম। পরবর্তী সময়েতে তো একটু একটু করে বহুমুখী হয়ে এই প্রচেষ্টা কলকাতা
ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার গ্রাম-গঞ্জেও। তার পাশাপাশি তলে তলে বাংলা কবিতা-চর্চার
ভূখণ্ডে এই সময়ে আরেকটা বড়ো ধরণের পরিবর্তন ঘটে গেছে। তা হল বাংলা কবিতার উপর বৃহৎ-পুঁজির নিয়ন্ত্রণ কায়েম। গল্প বা
উপন্যাসের মতো বাংলা কবিতাকে নিয়েও ভালো বাণিজ্য করা যায় বুঝতে পেরে
বাণিজ্যিক-গোষ্ঠীর সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় ক্রমাগত বিশেষ কিছু মুখকে তুলে ধরে
তাদের নিরঙ্কুশ আলোকিত করা। সেই কবিতা-চর্চার মধ্যে আশ্চর্যভাবে মার্জিত নাগরিক
সমাজের প্রাধান্যই চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ প্রান্ত-বাংলার প্রতিনিধিত্বকে সেখানে অনুবীক্ষণ দিয়ে খুঁজতে
হত। এতে আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না। বরং কিছুটা মনখারাপ থাকলেও বাংলা কবিতার কাছে তা পরম গৌরবের কথা। তবে,
যেটা আপত্তির এবং আতঙ্কের, তা হল এই বৃহৎ-পুঁজির পক্ষ থেকে সামগ্রিক ভাবে বাংলা-সাহিত্যের বৃহৎ পরিমণ্ডলে বিরামহীন মানসিকতায় নিজেদের
আধিপত্য কায়েম করার প্রচেষ্টা।
এই আধিপত্যবাদের বিপরীতে নগরে ও গ্রামে, প্রান্তিক জনভূমি থেকে
প্রকাশিত অজস্র লিটিল ম্যাগাজিন নিজেদের মতো করে একটা কবিতা চর্চার আবহাওয়া তৈরি
করেছে। সেখান থেকেও উঠে এসেছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কবিমুখ। তবু বেশির ভাগ
ক্ষেত্রেই গত শতাব্দির সত্তর ও আশির দশকে প্রকাশিত এই সব কাগজের একট উদ্দেশ্য যেন
তৈরি হয়ে গেছিল যে যে-কোনো ভাবে ওই বাণিজ্যক কাগজের নজরে পড়া এবং সেখানে প্রকাশিত
কবিতায় নিজের লেখাটিকে দেখে এবং দেখিয়ে পরিচিত পরিজনদের কাছে নিজেকে কবি হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করে নিজের কবিজন্ম ধন্য করা। ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়, তবে তা খুবই
অসংগঠিত এবং অনিয়মিত। এই পটভূমিতেই গত শতকের নব্বই দশকের প্রথম পাদে কবিতা
পাক্ষিকের আত্মপ্রকাশ।
কবিতা পাক্ষিক প্রকাশিত হবার পরে প্রথম প্রথম অনেকেই ভেবে
নিয়েছিলেন তা আর পাঁচটা কাগজের মতোই ভিড়ে মিশে যাবে, এবং তা গতানুগিতক ও
ক্ষণস্থায়ী হবে। সেই দিনের সেই শিশু কাগজটির ভেতর এতটা প্রাণশক্তি আছে তা উপলব্ধি
করতে অনেক মানুষই ব্যর্থ হয়ে ছিলেন। সেটা মানুষের দোষ নয়, আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস
থেকে জাত চিন্তা- ভাবনার খামতি । কারণ আমাদের এই চিন্তা-ভাবনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই
একটা ধরা-বাঁধা, গতানুগতিকতার ছকে বাঁধা। বেশির ভাগ সময় আমরা নিজেদেরকে সেই ধাঁচার
বাইরে নিয়ে আসতে পারি না। বা হয়ত চাইও না। কারণ সেটা রিস্কের। এই জন্যে নতুন কিছু
ভাবা, নতুন কিছু করা আমাদের ধাতে সয় না। আমরা নিজেদেরকে সব সময় একটা নিরাপত্তা
বলয়ের ভেতর আটকে রাখতে চাই। সেই কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরোতে চাই না, বা পারি না।
এবং তা হয়ত কতকটা নিজেদের অজান্তেই।
প্রকাশের দিন থেকেই কবিতা পাক্ষিক সেই গতানুগতিকতাকে অতিক্রম
করে নতুন কিছু ভাবতে চেয়েছে, নতুন কিছু ভাবাতে চেয়েছে, নতুন কিছু করতে চেয়েছে। বাংলার
কবিতা অনুরাগীদের একটা নতুন বার্তা দিতে চেয়েছে। তার এই কুড়ি বছরের অবিরাম
কবিতা-যাপন আজ আশা করি একথাটা প্রমাণ করতে পেরেছে তার সেই প্রচেষ্টার ভেতর কোনো
রকম ভান ছিল না। কোনো খাদ ছিল না।
কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের পটভূমিতে কিছু বিশ্বজনীন
ব্যাপার-স্যাপারও ঢুকে পড়েছে। সে সময়ে কমিউনিজিমে বিশ্বাসী মানুষদের চরম হতাশ করে
সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিরও পতন
ঘটেছে। বিশ্বজুড়ে নতুন অর্থনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে। শুরু হয়েছে এক নতুন প্রক্রিয়া,
যার নাম বিশ্বায়ন। এদেশেও শুরু হয়েছে উদারনৈতিক কাজকর্ম। বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন,
নগরায়ন, হাইওয়ে, উড়ালপুল, শপিং মল, আইনক্স
- এই সব শব্দগুলো তখন হামেশাই শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন, নগরায়নের পাশাপাশি অন্যদিকে ঘটে গেছে
আরেকটা মেজর ঘটনা। তা হল উচ্চ প্রযুক্তির জগতে এক যুগান্তকারী বিপ্লব। এসেছে
কমপিউটারের ব্যাপক ও বহুল ব্যবহার এবং অবশ্যই সারা পৃথিবীকে একটা গ্রামে পরিণত করা
ইন্টারনেট মহারাজ।
কবিতা পাক্ষিক প্রথম থেকেই এই সব পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষ করে, তার
সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা কবিতাকে আপডেট করার কথা বলেছে। বাংলা কবিতাকে আপডেট করতে
চেয়েছে। সে বলেছে পোস্টমর্ডানিজিমের কথা। সে বলছে পোস্টকলোনিয়ানিজিমের কথা। সে বলেছে
প্রান্তিকের প্রাধান্যের কথা। নব্বই দশকের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাতে সাড়া
দিয়েছে প্রবল ভাবে। কবিতা পাক্ষিককে তারা নিজেদের কাগজ মনে করে আপন করে নিয়েছে।
তাকে বেছে নিয়েছে নিজেদের আত্মপ্রকাশের প্রধান ভূমি হিসেবে। তাদের কাছে কবিতা
পাক্ষিকও দূরত্বের কোনো কৃত্রিম প্রাচীর তৈরি করেনি। সুতরাং গোটা নব্বই দশক জুড়ে
কবিতা পাক্ষিককে অবলম্বন করে তৈরি হয়েছে বাংলা কবিতার এক অবাধ মুক্তাঞ্চল। নতুন
নতুন দিশাতে বাংলা কবিতা ছড়িয়ে গেছে মনের আনন্দে। কবিতা লেখার প্রচলিত ছকগুলি যেন
উবে গেছে এক জাদুকরী ছোঁয়ায়।
এই পরিবর্তনকে তখন অনেকেই মুক্তমনে মেনে নিতে পারেননি। কিছু
পক্ষ থেকে প্রবল বিরোধীতা তো ছিলই তার সঙ্গে অজস্র নিন্দা, টিটকারী কিছুই বাদ
যায়নি। কিন্তু তাতে করেও কবিতা পাক্ষিককের পথ হাঁটাকে বিন্দুমাত্র দমানো যায়নি। সমস্ত
নিন্দা অপমান উপেক্ষা মাথা পেতে নিয়ে সে নীরবে নিজের কাজটিকে সুষ্ঠ ভাবে করার
চেষ্টা করে গেছে। এক জায়গায় থেমে থাকেনি। তার মধ্যেও বিস্তর বদল এসেছে। অনেক চেনা
মুখ সরে গেছে। অনেক নতুন মুখ উঠে এসেছে। লেখালিখির দিক দিয়েও এই কুড়ি বছরে অনেক
বাঁক-বদল ঘটে গেছে। বারে বারে বাংলা কবিতার মর্জি বদল হয়েছে। নব্বইয়ের প্রবল উচ্ছ্বাস
থিতিয়ে গেছে। নতুন সহস্রাব্দে নতুন শতকের শুন্য দশকে উঠে এসেছে প্রযুক্তিমনস্ক পরিবর্তন-অনুরাগী
নতুন ছেলেমেয়েরা। ট্রাডিশনালের সঙ্গে অনায়াসে মিশে গেছে কন্টেমপোরারি। শপিং-মলে নিত্য-নতুন
ব্রান্ডের ভোগ্য-পণ্যের পাশাপাশি অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে বুকে চে-গেভারার মুখ আঁকা
টি-শার্ট। সোশাল নেটওয়ার্কের দেয়ালে দেয়ালে, ব্যক্তিগত ব্লগে, ব্লগজিনে প্রতিদিন
প্রতিরাত প্রতিমুহূর্তে লেখা হচ্ছে অজস্র কবিতা। সকালের পোস্ট ঢাকা পড়ে যাচ্ছে
বিকেলের পোস্টে। সন্ধ্যারাতের লেখাগুলি পুরোন হচ্ছে মাঝরাতে। কে তাদের দেখল, কে
লাইক দিল, কে কেমন কমেন্ট করল তাতে কারো কিছুই যায়-আসে না। প্রকাশের আনন্দেই সবাই
মশগুল। যেন শব্দের এক বিশাল উৎসব।
যেখানে বিখ্যাত অখ্যাত ভালো মন্দ এসব চেনা গণ্ডিগুলো লুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু জেগে
আছে এক সেলিব্রেশন। এসব কিছুকেই কবিতা পাক্ষিক আত্মস্থ করেছে নিজের মতো করে।
দুই দশকের এই সময়কালে বাণিজ্যিক কবিতা মহলেও কিন্তু ঘটে গেছে
নানান সব পরিবর্তন। একদিন যাঁরা পোস্টমর্ডানিজিমকে অনেক নিন্দা-মন্দ করেছিলেন,
উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করেছিলেন, নতুন সময়ের নতুন ফেনোমেনাকে ক্রমে ক্রমে তাঁরাও মেনে
নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন আর পোস্টমর্ডানিজিম তাঁদের কাছে অচ্ছুত নয়, কারণ তাঁরা
বুঝতে পেরেছেন এই পোস্টমর্ডানিজিমও বেশ বাণিজ্য-সফল। সাব-অলটার্নের গুরুত্বকেও
তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন। একটু লক্ষ করলে সেই কাগজে প্রকাশিত এখনকার কবিতায় এই
সব পরিবর্তন সহজেই নজরে পড়বে। তবে তাদের আধিপত্যবাদ বিস্তারের প্রক্রিয়াটি এখনো
সমান ভাবে সক্রিয়। নতুন লেখালিখির গুণাগুণ বিচার করিয়ে তাদের পোষিত বুদ্ধিজীবী
সমাজকে দিয়ে ক্রমাগত বলানো হচ্ছে এসবই আসলে মধ্যমেধার মহা-বিস্ফোরণ। এখনকার সমাজে
ও রাজনীতিতে তাই উগ্রপন্থী সন্ত্রাসের পাশাপাশি এই ধরণের বুদ্ধিজীবী সন্ত্রাসও হয়ে
উঠেছে এক উল্লেখযোগ্য বিষয়।
কবিতা পাক্ষিক কখনো আধিপত্যবাদে বিশ্বাস করে না। কিন্তু মুশকিল
হল যাঁরা আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী, কবিতা পাক্ষিকের ধারাবাহিক প্রকাশ ও ক্রমবর্ধমান
জনপ্রিয়তায় তাঁরা একদিন সম্যক টের পেলেন যে তাঁদের পায়ের তলার মাটি ক্রমশ আলগা হয়ে
যাচ্ছে। সুতরাং একটা কিছু করা দরকার। ফলে বাণিজ্যিক পত্রিকার জগতে তো একটা
পরিবর্তন হলই, শুরু হল কবিতা পাক্ষিক থেকে উঠে আসা নতুন কবিদের দলে টানার পালা। আর
সাহিত্যের সেই প্রধান মালগাড়িতে যাঁদের জায়গা দেওয়া গেল না, তাঁদের জন্যে মেয়েদের
রূপচর্চার জন্যে প্রকাশিত ম্যাগাজিনেও খোলা হল কবিতা বিভাগ। অন্যদিকে নতুন কবিদের
দলে টানার জন্যে এক বিখ্যাত ও জনপ্রিয়
ব্যক্তিত্বকে সামনে খাড়া করে ষাট দশকে ফুরিয়ে যাওয়া তখনকার বিখ্যাত কবিতা পত্রিকাকে
নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করা হল। কবিতা পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে তৈরি হল
আরো অনেক নতুন নতুন উদ্যোগ। যা বেশ রঙ-চঙে ও মনিহারি। কবিতা পাক্ষিক এসবের
বিরোধীতা করে না। কারণ সে জানে এসব কিছুই সামগ্রিক ভাবে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে
ভালো ফল দিয়েছে। কবিতা পাক্ষিক জানে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে কবিতা
পাক্ষিকের অনায়াস গ্রহণযোগ্যতাকে মোকাবিলা করার জন্যে এই প্রচেষ্টাগুলি দানা
বাঁধলেও তারা নিজেদের অগোচরে কবিতা পাক্ষিকের মিসন ও ভিসনকেই মান্যতা দিয়েছে। কবিতা
পাক্ষিকের শুরু করা কাজকেই তারা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবে কবিতা পাক্ষিকের কাজ এখনো
ফুরোয়নি। কারণ পরিবর্তন কখনোই এক জায়গায় থেমে থাকে না। সেই পরিবর্তনের পাতাকাকে
যথাযথ তুলে ধরার জন্যে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতেই হয়। এতদিন কবিতা পাক্ষিক খুব
বিনীতভাবে সেই কাজটাই করতে চেয়েছে। আগামীতেও তা করে যাবে।
একটা কথা বলে এই লেখা শেষ করতে চাইছি, কবিতা পাক্ষিককে যাঁরা
সহ্য করতে পারেন না, তাঁরাও আশা করি আজ তাকে স্বীকার করে নেবেন। আর কবিতা পাক্ষিক
প্রকাশের আগের বাংলা কবিতা এবং কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের কুড়ি বছর পরে আজকের বাংলা
কবিতা এ নিয়ে আপাদমস্তক কাজ করতে আগ্রহী-জনেরা একদিন নিশ্চয়
এগিয়ে আসবেন। তাঁরা বলে দেবেন বাংলা কবিতার এই প্যারাডিম শিফটে কবিতা পাক্ষিকের
আদৌ কোনো ভূমিকা ছিল, নাকি সব কিছুই এক তামাশা। আশা করি সেদিনও খুব বেশি দূরে নয়।