62nD pOsT : কবিতার টসটসে বোতল / নবেন্দু বিকাশ রায়


আমি ছোট বয়স থেকেই যাকে বলে এঁচড়ে পাকা। যে সময়ে আমার রূপকথা পড়ার কথা ছিল সেই বয়সে আমি পড়েছিলাম রাজর্ষি। কিছু করার নেই। দাদু বাংলার শিক্ষক হবার সুবাদে, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত বাঙালীর স্টেটাস সিম্বল রবীন্দ্র রচনাবলী আমাদের বাড়িতে জ্বলজ্বল করে টাঙানো থাকত। ভাবখানা এই যে আমায় পড়ুন নইলে পিছিয়ে পড়ুন। অবশ্য রাজর্ষি দিয়ে রবি ঠাকুর পড়া শুরু হয়নি আমার। প্রথমে এসেছিল গল্পগুচ্ছের কিছু গল্প যেমন যতদূর মনে পড়ছে কঙ্কাল, ঘাটের কথা এগুলোপ্রথমে রাজর্ষি পড়ে আমার একদম ভালো লাগেনি। শুধু একটা সংলাপ গেঁথে রইল। “এত রক্ত কেন”? সেই বয়সে বোঝার কথা ছিল না, বুঝিওনি তবু মনে হত, এই বাক্যটায় কি যেন একটা জাদুপরে, মানে যখন ক্লাস সিক্স বা সেভেন তখন আবার রাজর্ষি পড়ি এবং কি আশ্চর্য তখনও এই বাক্যটায় আমি আটকে রইলাম। এই এমন এক কথা যা শুনতে ভালো লাগে, পড়তে ভালো লাগে। কথাটা বাচ্যার্থ ও ভাবার্থ দুই পেরিয়েও কোথাও গিয়ে টিঁকে থাকে। এখনো লাইনটার বিদ্যুচ্চমক আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়নি।

কবিতা লেখা শুরু তার কিছু আগে। ক্লাস ফোরে। কেন লিখেছিলাম প্রথম কবিতাটি, কেন ভালবেসে পড়তাম সুকান্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ তার কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি, আমার পাশের বাড়ির সাগরিকা ছিল আমার প্রথম পাঠিকা। একটা লম্বা-চওড়া ডাইরি কোথা থেকে যেন হাতিয়েছিলাম। কবিতা লেখার পাশাপাশি প্রচুর গল্পও লিখতাম তখন। অ্যাডভেঞ্চার আর গোয়েন্দা।

এইভাবে অর্থা ৯৯ শতাংশ বাঙালি কবির মতোই আমার লেখালেখি শুরু হয়েছিল। যদিও শুরু হওয়াটা কোন বিষয় নয়। বিষয় হতে পারে হয়ে ওঠাটা। কবিতা চোখে কানে লেগে থাকার একটা ঘোর থাকে। এই ঘোরটা যতদূর মনে হয় নিজেকে আবিষ্কারের। মফস্বলের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালানো আসলে একটা ঋতু। এই একটা ঠাণ্ডা আর অন্ধকারঘন রাস্তায় যেতে যেতে বারবার ভেতরে চোখ চলে যায়, আটকে থাকে। শুধু কবিতার আকারের শব্দবিন্যাসটা নয়, তার being and becomingটাই কবিতা।
প্রশ্নটা একটু দূরে গিয়ে কমিউনিকেশনের হয়ে যায়। Textual communication, ভাবখানা এইরকম যে, আমার কথা যদি তুমি বুঝতে না পারো তাহলে বোঝানরও কোন দায় নেই আমার। প্রত্যেকবার প্রেম করার সময় একটা দীর্ঘ কবিতার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে আমার, যে কবিতাটা আমি কখনো লিখে উঠবো না কারণ কবিতাটা তো অলরেডি লেখাই হচ্ছে। আমাদের পারস্পরিক ছানাছানির মধ্যে। তাহলে আমি লেখায় বাঁচব আমার মত করে। এটা হয়ত অভিমান। কিন্তু বড় মোহময় সে অভিমান।

“প্রপঞ্চ ইত্যাদির কথা হয়
একটা মোম থেকে গলে যাচ্ছে মোমের ছায়াটুকু”

কবিতায় দুই, Observation আর Obsessionফলে যেকোনমুহূর্তই সাংঘাতিকভাবে ব্যক্তিগত। তাহলে আমার ব্যক্তিগতকে কি আমি কবিতার অছিলায় শেয়ার করতে চাইছি। একদমই তা নয়। আমি লেখাটায় একটা আমি বানাতে চাইছি। ধরো, সে আমির কাঁধে একটা ঞ অথবা ইস্তানবুল। একজন কবিকে যদি তার কবিতার ভেতর বাঁচতে বলা হয় তাহলে তো তার জীবন আর কবিতা গুলিয়ে যেতেই পারে। তার Cerebral Exerciseটাই সর্বস্ব।

“আমাদের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে ; একথা বলতে তুমি যা ভেবেছো এমনকি ১২০ জনপদের বাসিন্দারাও ভাবেনি । ১২০ জনপদে যে ৩৬০ খানাই ঘর থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি । আমি তো এখনো ভাবি কারোর নিশ্চয়ই চোখের লোয়ারকেসে গোয়েন্দা যাচ্ছেন । গোয়েন্দা পাইপ খাচ্ছেন । একটানা বুঝিয়ে যাচ্ছেন জল ও বৃষ্টির পার্থক্য”

এটা বলার সময় আমি কিছু আড়াল করে চলেছি। একটা আইডিয়া যদি বৃত্তাকার হয় তাহলে তার ক্রমশ সরে সরে যাওয়া একটা ঝাপসা বলয় তৈরি করে। আমি থেকে তুমি, তুমি থেকে সেফটিপিন, সেফটিপিন থেকে আংরাখা। আমি দেখি কিভাবে অর্থ আসে, মিনিং চলে যায়। কবিতাকে মিনিংফুল করে তোলার জন্য আমি তো এই শব্দমালা স্যাক্রিফাইস করেছি, আর কি চাও তুমি আমার কাছে থেকে? বরং উল্টো দিকে এসো তোমায় আমায় একটা স্পোর্ট গড়াই। তুমি কবিতা বানাও আমি কবিতা বানাই, আমাদের কবিতাগুলো কোথাও গিয়ে একটা তৃতীয় কবিতা বানাক। তৃতীয় কবিতা আবার কোথাও গিয়ে ফট শব্দে ফেটে পড়ে, ছেতরে থাকে তার মেধা আর ইমোশন।

নীলোফারকতবারনীলফেলেগ্যাল
একটাগোলরঙেরআলোয়অনন্তড্রাকুলাপড়েআছে
তারখিদেরনামঅনন্ত, সেক্সওবটুয়ারনামওঅনন্ত

নবনীতা বলে আমার সমস্ত ইমোশন নাকি দাঁতে। কথাটায় আমার আপত্তি নেই। আরও ভালো হত যদি আবেগ থাকতো নখের ডগায় কিংবা চুলের মত মৃত কোষে। আহা তাহলে তো আমি নাচতুম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখনো আমার ব্রেন পেরিয়ে আমি দেখতে শিখলামই না।  ভাবা যায়, আমাদের সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি একটা জায়গায় জমা হচ্ছে, প্রসেসড হচ্ছে, কিন্তু তার নিজের কোন অনুভূতি নেই! হাউ ফানি!আইরনিও বলা চলে।

তাহলে নবেন্দুকে কি অস্বীকার করতে চাও? হ্যাঁ, চাই তো। একশবার চাই। আমি যদি লিখি, “মিস্ট্রি পেঁচিয়ে ধরেছে চুলের নীচেকার উষ্ণতা, উম উম ভাব/আর ওই সহাস্য মাংসের ক্রিস্প/যেমন ঘাড় ড্রিল করে ঢেলে দিচ্ছে/
ইমোটিকনস্/এই শাদা চাদরে রক্ত লেগে থাকার মোটিফ” তাহলে আমি  নিজের লিবিডো নিয়ে নিজেই মশগুল। পাঠকের কি দায় আছে তা শোনার? সুতরাং আমাকে বাঁচতে হবে ওই যকয়, গ, যক্ষ্মা, সেউ, দসবকভহ, সগফ্বক্য, ইউব, চেওফ,দসিওএরুগ্লক্রেব এসবেরই মধ্যে। কি বললেন? অর্থহীন?

তাহলে একটা গল্পই বলিঃ

“সুইচবোর্ড থেকে আলো ফেলছে শাহেনশা
এই ভঙ্গীমায় মেয়েদের হাতব্যাগ
সিস্টার্ন ও সিস্টার্ন পর্যন্ত যেকোনো
ন্যাপথ্যালিনের দেবতারং ; একটি বসন্ত
                গিলে খাচ্ছে
আরেকটি বসন্তের খিদে

ওই যোনির ভেতরে বুম নিয়ে বসেছে
নির্জন স্টেশনমাস্টার”

কবিতাকে, এই পর্যায়ে আবহবিকার মনে হচ্ছে আমার।