63rD pOsT : কবিতার প্রশ্রয় কবিতার আশ্রয় / রমিত দে


কিছুতেই মনে করতে পারিনা প্রতিটা পাতার নাম। জানলা থেকে যে দুটো পাখি উড়ে যায় বুঝিনা কোন আনন্দবায়ুর দিকে তারা ডাক তুলতে যায়! হাজার হাজার পাখি, আলোর বাঁকে হাজার হাজার অভিসার। একটা আয়না একটা এন্ট্রান্স কোন রূপময়তা আমাকে প্রত্যক্ষ করছে? বার বার চেষ্টা করছি বানিয়ে তুলতে সেই কুঁড়িটিকে যা বার বার আচঁডাচ্ছে আমাকে- হয়ে উঠছে আমারই প্রতিচ্ছবি। কত বড় একটা আশ্রয়; কত বড় একটা অতিক্রমন; চিন্মোহন প্রকৃতির মাঝে দাঁড়ালেই মনে হয় নির্মান চলেছে, আরও গভীর করে সাজাতে সতীর্থ খুঁজতে চলেছে শব্দের সত্য। আশ্রয়ের রঙে লুঠ হয়ে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছে অন্তর্বতী পংক্তি। ফুল ভয়েজে একটা সহজ কনট্যুনিইটি, গোছানো অহংকার ছেড়ে একটা দোলা আর দোলার ভেতর একটা মৌন ঘোষনা, সীমাবদ্ধ মানুষের সানন্দে প্রকৃতির কী বিপুল স্বীকারোক্তি! বন আছে, জলরঙে আঁকা, বনের নাম নেই, নাম আছে বাতাসের বুকে, পাতাদের নির্জনে মাটির খবর, শিকড়ের অভীপ্সা। যেন অনন্ত থেকে নামি ছায়াপথে, সুন্দরী গতঙ্গ গাঁওয়ে। চাকরীসূত্রে দেশ থেকে প্রদেশে যাওয়া আমার অব্যাহত;ট্রেন থেকে নামি,জেটি পেরোই,তারার আলোয় অনিশ্চয় খুঁজে খুঁজে ফিরে আসি মধুমতী শূণ্যতায়। কোনো এক কুড়ানী জীবন উঠোনের কোনে বসে থাকে কুপি হাতে।এ যাওয়ার ভেতর কোন আধাঁর নুনের জমক নেই। কেবল পায়ের নিচের মাটি আর তার নির্দেশ। জীবনমরনজন্মের মাঝে চলমান সংলাপ, যেদিকেই তাকাই সেদিকেই ফুটে ওঠা গোপন রংগুলি,নিয়মে রচিত হওয়া শব্দ, মুখে হাত চাপা দিয়ে  তারা হাসছে, নিয়ে চলেছে  এক পরিযায়ী স্মৃতিগন্ধে। এই কি কবি্তা! আত্মবহিভূর্ত ইলাস্ট্রেশন! আঙুল ছুঁয়ে দিলেই একটা অদ্ভুত রামধনু, বিস্ফোরন হল আকাশের। আলোকবিন্দুগুলোকে জড়ো করে আমরা গেলাম অনির্ভরকে খুঁজতে; মাঝে কেবল শব্দের জন্মান্তর, অবাক পাঠকের মত বাঁশপাতার মজলিস-তাদের চিত্রার্পিত সান্ধ্যভোজ-মর্মরের জন্য দীর্ঘশ্বাসের জন্য কোমল দেবতার দিকে কি নবীন তাদের ক্ষমা চাওয়া! এই কি কবিতা নয়? আরেকটি শব্দ কি এখানেই বেজে ওঠে না? এই মোহিনী ভ্রমনের ভেতর আলাদা করে ভাবা যেতে পারে না কি আরও এক সহস্র বছর? যেখানে যাত্রা কোন দিকে নেই, যেখানে যাত্রা বেজেই চলেছে বীজ পুঁতেই চলেছে অভিজ্ঞতার মাপে সম্ভাবনার মাপে। এই বিশালতার কাছে এলেই মনে হয় কবিতা নিয়ে আনেক তো হোলো, গবেষনা, আন্দোলন, স্পর্শ করার কত বিশুদ্ধ চিন্তা অথচ তার সংযুক্তির কাছে তার দুষ্প্রবেশ্যতার কাছে পৌঁছলাম কোই? কবিতার দায়বদ্ধতা তো সহজাত অভাবের দিকে। হয়ে ওঠার জমাটবদ্ধ প্রশ্ন সেখানে অবাস্তব অবান্তর , কবি সেই টাইম ট্রাভেলার যে  নিশ্চিত ভাবেই স্পর্ধা করছে অজ্ঞেয়কে ছুঁতে চাওয়ার, ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বার বার আকর্ষিত হচ্ছে একটা ইমাজিনাল পেনিট্রেশানের দিকে - প্রকৃত বাসার দিকে ।বার বার নিজের কাছে অস্বীকৃত হচ্ছে নিজেকে চেয়ে, শব্দের ক্ষেত থেকে প্রতিদিনই সে নিজেকে রিসাইন করছে রিজেক্ট করছে তার চেতনাকে সন্দেহ করে প্রতিন্যাসকে পেতে চেয়ে, অস্পষ্ট স্থানিকতা ছেড়ে তার আদলে তৈরী করছে কবিতা তার সাজাইগোজাই আর অপরাহ্ন ফিরে গেলেই কেবল পড়ে থাকা শব্দের প্রসব বেদনা , সবকিছুই তো কবি দেখছে - সীমানা নিয়ে কিভাবে সে নিঝুম হোলো কিভাবে বিস্মৃতির হলো! এই বিস্মৃতি কবির নিজের, তার জাগরূক অভিজ্ঞতার, এই বিস্মৃতি চেতনের সেই বর্ণচোরা গর্ত ভরাট করতে করতে সমিধ হয়ে যাচ্ছে আলোকিত পরাগে


           কেমন হয় সমগ্রতার দিকে গেলে? জীবন-জন্মের খেরোখাতা খুলে বা বুঁকে ব্যথা নিয়ে ঘাড় গুঁজে টেবিলে মুখ রেখে একটা নিরেট ভারসাম্যের দরজা খুললে? একটা স্বপ্নচর্চী কবিতা লিখলে! কিন্তু কি লিখব? কোন নিগূঢ় নির্মেদ আনন্দে! সব কিছুই তো খণ্ড খণ্ড ক্ষণকালের। কবিতা তো সেই ডানা সেই কুড়োনোর আকাঙ্খা যা এক বিন্দুতে কখনই থেমে থাকবে না; এক বিন্দুতে থেমে থাকা কবিতাও এক হবে না, ঠেলা দিয়ে বলবে - পাহাড় দেখিছা? মাটির মহিমা দেখিছা? দেখা নাই কেতিয়াও? ময়ো দেখা নাই, শুনিছোঁ তথাপি।কাগজর ফুল লগাই বিজুলী ফুল লগাই মাটি ওলাই গল, এখকন চিত্র রাখি সেউজিয়া চিঠি রাখি অলপ গদ্য রাখি ধরি লোওয়া ডালত কুবুলি মাতিছে,----- সে পাহাড় দেখবে, দারুহরিদ্রার গাছ দেখবে, সোনারের ফুল দেখবে ,চেনা মানুষ থেকে অচেনা মনন দেখবে, অপেক্ষা করবে বিরোধাভাসকে খুঁজতে চেয়ে। আনফ্যাদামেবল ফ্রিডম নিয়ে আঁকতে চাইবে অ্যাবসুলিউট ক্রিয়েশন। just a map or even a tree or a stone/ to mark a spot I could return to/ even when there’s nothing to return for….যে ছেলেটি আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে এই আনকোরা গাঁওয়ে তাকে আমি চিনিনা অথচ তার শরীরের বাজনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটা বির্কীনতা,যে মেয়েটি মেখলা উড়িয়ে চলে গেল জমাটি বাগানের দিকে তার গন্তব্য মানেই তো একটা নিমেষহারা  নদী, একটা ধোঁয়া রঙের সন্ধ্যামালতী। চলাচলের মধ্যে এই যে প্যাসিভিটি তা যেন বলে থেমো না,কোথাও থেমো না। পৌঁছনো মানে ছুঁয়োনা, কেবল ভিখারিনীর মত দাঁড়িয়ে থেকে থেকে নিবিড় হও এই সুক্ষতার কলধ্বনিতে।আসলে এই যে জীবনের কথা খোদাই করে চলেছি এই যে পুঙ্খানুপুঙ্খ একটা অক্ষয় অমূর্তের কথা তা আদতে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসআলোবায়ুআসক্তিবৈরাগ্য এমনই কিছু ব্যাসাল সোরস থেকে নেওয়া এমনই কিছু মূর্ত কোলাহল থেকে; এই পজিসনল কনশাসনেসের ভেতর তোমাকে দেওয়া হয়েছে পিওর অটোনমি, এবার তুমি আলিঙ্গনের মধ্যে অস্মিতার মধ্যে অঙ্গীকৃত হও, নতুনভাবে জন্মলাভ করতে চাও। আর গল্প করতে করতে এভাবেই একদিন আবহমান থেকে নকশা ছিঁড়বে কবিতা, লক্ষণরেখা ছিঁড়ে ফেলে বেড়াতে বেড়োবে অ্যাস্থেটিক জয়মেন্টের ভেতর, খড়কুটোর মত ভেসে যাবে জ্যোর্তিময়ের দিকে, সে তো নিরুদ্দেশ চায়, স্যাঁতসেতে মানুষজন্ম চুরি করে হাসে, সামনের চিৎকৃত শূণ্যময়তা নিয়ে সে যে কিছু চায় সে যে কিছু দেবে এমন তো নয় , কেবল একটা ইনফিনিট ডিস্ট্রান্সে গিয়ে আমাদেরকে আলাদা করে দেবে আমাদেরই থেকে, ছায়ার জন্ম হবে।সম্বন্বয়ের থেকে জন্ম হবে সমান্তরালের। রহস্যের। 
     পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো রহস্যদেখবার বস্তুটি নয়, যে দেখে সেই মানুষটি। এই রহস্য আপনি আপনার ইয়ত্তা পাচ্ছে না; হাজার হাজার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আপনাকে দেখতে চেষ্টা করছে। যা কিছু ঘটছে এবং যা - কিছু ঘটতে পারে, সমস্তর ভিতর দিয়ে নিজেকে বাজিয়ে দেখছে। এই - যে আমার এক আমি, এ বহুর মধ্যে দিয়ে চঞ্চলে চঞ্চলে নিজেকে নিত্য উপলব্ধি করতে থাকে। বহুর সঙ্গে মানুষের সেই একের মিলনজাত রসের উপলব্ধিই হচ্ছে সাহিত্যের সামগ্রী। অর্থাৎ, দৃষ্ট বস্তু নয়, দ্রষ্টা আমিই তার লক্ষ্য।।(জাপান যাত্রা) -সেই কবেই তো রবীন্দ্রনাথ শুনিয়ে গেলেন বিযুক্তির খেলা; নতুন কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? আমি সর্বস্বতা থেকে বেরিয়ে এসে ব্যক্তিত্ব বিলোপনই কি ছিল তার সহজ অনুপমে? নাকি সেলফ অবসারভিং-এর দিকে আঁকা হল তার শেষ প্রচ্ছদের কবিতা! উপনিষদের দ্রষ্টা পাখিকে নিয়ে তিনি আসতে চাইলেন দর্শনে, বিষয় বস্তুর বাইরে বিন্যাসের বাইরে  অথবা সেই অসনাক্ত রহস্যে, যাকে কবি খুঁজছে, চৈতন্যে মেশাতে চাইছে পাঠক  । ধরা যাক খেড়ো চালের ওপর কোকিল দেখলাম শালিক দেখলাম, যুক্তির জন্ম হল ধারনার জন্ম হল সমগ্রতার জন্ম হল,অথচ স্পষ্ট দেখতে পেলাম কেউ পথ দেখাচ্ছে শুরুর দিকে কেউ আয়নামহলে দেখাচ্ছে যোগমগ্ন প্রলাপগুলি,পাখি তো নেই-এই জগতগ্রন্থির মাঝে কেবল কিছু ওড়ার দাগ কেবল কিছু হাঁটার ভঙ্গি যা সব জরিপ সব রঙ থেকে তুলে আনছে কবিতার আলোয়ান।কুরোসাওয়ার সেই ড্রিম ছবিটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যেখানে ভ্যান ঘগের প্রদর্শিত ছবি দেখতে দেখতে দর্শকটি ক্রমশ ছবির ভেতরে ঢুকে পড়ছে প্রতিকল্প হিসেবে, যেখানে আমরা এক প্রিডমিন্যান্ট রিফ্লেকটিভ টোন লক্ষ্য করছি অন্তর্বস্তুর দিকে, এসেন্স অফ মিথে। কালেকটিভ আনকনসাসে। আমাদের থাকা এবং ফিরে যাওয়া আসলে একটা উচ্চারিত পরিক্রমা যার কোনো সাক্ষী নেই ,সেজে গুজে অপেক্ষা নেই, কেবল একটা অতসী আঁধিয়ার ভেতর একটি পথ একটি ডিহি-মায়ার উপর সে কেবল টলমল করবে। কী খুঁজছি? এই অকূলবিস্তীর্ণ কোহেরেন্সে এই সুদূরিম ডাকের মধ্যে ঠিক কিসের নির্মাণ? যাত্রার কথা কি জীবনানন্দ বলেননি? যাত্রার কথা কি এলিয়ট বলেননি? জীবনের আর্তির প্রেক্ষিতে এলিয়ট তো জীবনানন্দের পুনরাবৃত্তিময়তার থেকেও এগিয়ে ছিলেন আরও কিছুটা। এটারনাল রির্টানের কথা! সেও তো বলা হয়ে গেছে কুন্দেরার আত্মবীক্ষনে। তবে নতুন কোথায়? কোথায় অসুস্থতা গাঢ হয়ে অনুমোদন করছে আগমনকে!
           আসলে অনশ্বর বলে কবিতাই কিছু নেই,সব কবিতাই আদতে নতুন,গুটিপোকার মত সে তার পোশাকের মধ্যেই ঘর বাঁধছে, পোশাকের মধ্যেই তার শব্দস্ফটিক নিয়ে গুটি গুটি এগিয়ে চলেছে পশমের  অজানা তত্ত্বে।কবি তিলে তিলে গড়ে তুলছেন তার মনোভঙ্গিটি যা  প্রচণ্ডভাবে চেনা ঘর থেকে টাঙাবার হুক থেকে বাতিদান থেকে উদ্ভুত, যা রিয়েলিটি থেকে উন্মীলিত অথচ সে তার অর্জিত দরজা থেকে লুকিয়ে খুঁজছে এলিভেশন, ধ্যানমগ্নতা। কবির বাস্তব জীবনআলেখ্য থেকে খননের দরজা খুলে বেঁকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়ছে কোনো এক অন্তর্গূঢ আলোকযাত্রায়।যা ব্যক্তিগত তাই তো স্মৃতি আর যা স্মৃতি তাতেই তো শব্দের আনন্দযাত্রা, সেখানে আর ফেরা হয় না , কবিও বোধ হয় সাধনা করেনা সেই ফেরার।অথবা কবি জানেই না তার অনুসন্ধানের বাইরে রয়ে গেল এই একান্নবর্তী বর্হিলোক এই টিনের সুটকেশ এই ঋতুর লাফ , ক্যালেন্ডারের খাঁজে খাঁজ়ে গুঁজে রাখা ঘর বিষয়ক অনুশীলন অর্থাৎ এই থাকাটূকু যা তাকে দ্বিতীয় পৃথিবীর দিকে গৃহনিষিক্ত আরণ্যকের বিন্যাস দেবে, কবি বিচ্ছিন্ন নয় সে কেবল মুখ ভেঙচে আলাদা থাকার কথা বলে, দেখায় না তার ঘর ফিরতি জলের গন্ধ তার চলতি আমির ছাঁচটাকে আর আমিহীন স্ববিরোধেই যেন তার অভিনিবেশের প্রারম্ভ। এই যে সারাদিন বৃষ্টি সে তো কবিও জানে , জানে প্রতিটি ঝরে পড়ার অভ্যেস অথচ স্বীকার করবে না , আর অস্বীকৃত হতে হতেই বাস্পায়নের মত বিশেষ করবে যা বিদ্যমান , যেন বৃষ্টির সাথে বৃষ্টি বৃষ্টি খেলা , বৃষ্টি তার কাছে কখনও অভাব কখনও বা পরিত্রান, যেন আরও বেশি করে জল হয়ে উঠছে জলের কোলাহল; মহৎ ভাষা বলে কিছু হয় কিনা জানিনা তবে মহৎ স্তব্ধতা বলে অবশ্যই সিঁড়িভাঙা এক অপ্রবাহ আছে যা শব্দের শরীর থেকে তার গর্ভবাসের দিকেই ক্রমাগত দ্বিধান্বিত হয়। যেমন বৃষ্টি শব্দটাকে যদি টুকরো টুকরো করে দিই তাকে আর কাহিনী হতে না দিয়ে ডেকে নিই ভেতরবাড়ির দিকে এই যে কবিতার  বীজ এই যে দু এক পশলা শব্দ তার ভেতরেও কি দু চারটে লাল মাছ নীল মাছ ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না!দু চারটে জল কেউ কেউ কুড়িয়েও নেবে দু চারটে বেপরোয়া অক্ষরের ঠোঁট।বৃষ্টি খুললেই মনে হবে মেঘের কথা,মেঘ খুললেই সাংকেতিক হরফ, কবি হয়ে উঠবে বেভুল,অসংখ্য থেকে সংক্রামিত হবে মুদ্রিত শব্দটি, খুলে যাবে অনন্ত জানলা। এই থাকা এই আত্মময় জাগরন বেদখল হয়ে যাবে কবিতার পলিমাটিতে……
এখন চোখ খোলা আর বন্ধ করার মাঝেই ও দেখে ফ্যালে এ জন্ম
পরজন্ম-গতজন্মের সব বৃষ্টির দাগ। দূরে, এক ফেরিঘাট……সেখানে দারুন
সব নৌকো পাল তুলে চলেছে এগিয়ে।
কিছু কিছু বৃষ্টি এ জন্মেও এসে পড়ে আমার চশমায়
                               ……”( নিমাই বন্দোপাধ্যায়)
                স্পষ্ট টের পাচ্ছি জলের দ্বিতীয়তা নেই অথচ জলের দিকেই কবি খুলছেন তার শুকনো পোশাক।শব্দ থেকে পৌঁছে যাচ্ছি ব্রম্ভে। বিশ্বাসে। যেন যাওয়ার ছিল কোথায় অথচ ইগলু থেকে এক নিরাপত্তাহীন অনধিগম্যে ছুঁড়ে দেওয়া হল গোছানো ধারাবিবরনী । শেষতম পুঁজি নিয়ে কবি এলোমেলো করে দিচ্ছেন প্রতিটা আবহমানিক সৌজন্য; বারবার হলুদকার্ড দেখাচ্ছেন অনায়াসকে, সেই ধারন কে যে ঘর বাঁধতে চায়। আসলে ফিরিয়াও যে ফিরিয়া আসিতে চায়না কবিতার একটি শব্দও,ভূমিষ্ঠ হয়েই সে তৃণ অবধি আকর ছড়িয়ে দেয় মুক্তির।সে তো নিজেকেই সর্জন ,পরিধিগুলোকে নিভিয়ে ফেলে কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তাবিত করা। সেখানে শব্দ ব্রম্ভ। শব্দ বিশ্বাস।  শব্দ বোধি, খোঁজবার খেলা, এক অজ্ঞেয়ে আক্রান্ত হওয়ার খেলা,  জুড়তে জুড়তে তেতাল্লিশে এসে দেখে এতোদিন যা ছিল তা আসলে না হওয়ার মধ্যে ছিল, তাকে কেউ স্বীকারই করে নি কিম্বা সেই শীতকথার ভেতর তার নিঃসঙ্গ আমসত্ত্ব বিছিয়ে বাজনাহীন ফকিরিকে তুলতে গেছে। কিছুই মনে পড়ে না, কত সহজভাবে চোখ বন্ধ হয়, তণ্ডুল ফেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শব্দ ডুবতে থাকে জল চুরির লবনে , একমাত্র শব্দই আসে নিটোল অনুপস্থিতি হয়ে প্রতিটি প্রত্যাহারকে নিভৃতি করে চলে যায় দূরে,  পাঁজরের হাড়ের কাছাকাছি, ফুসফুস ছাড়া যেখানে আর কোন বিকল্প জীবন  নেই, এ নিয়েই ঘনিয়ে ওঠা , কবিতার পাশাপাশি বসে থাকে এমনই এক  ভেজা সাইকেল যে হাঁটতে হাঁটতে ফুটে ওঠে ইশারার দিকে। নির্বিকার ঝাপটানির দিকে।
শ্রেষ্ঠ কবিতা ঠিক কি! প্রাচীনতম সাহিত্যের দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যাবে প্লেটো হোরেস ডিমেট্রিয়াস বা লঙ্গাইনাসে মত তাবৎ ব্যাক্তিত্ব কবিতাকে সে যুগেই অন্তক্ষন থেকে মুক্তি দিয়েছেন অফুরন্তে। সীমাবদ্ধতা থেকে উপ্ত করেছেন সম্ভাব্যতা; হয়তো অনেকেই লঙ্গাইনাসকে স্বীকার করে নেন থিওরি অফ ইমাজিনেশানের জনক হিসেবে যখন তিনি বলেন the magic of literature is not the sum of its ingredients… something over and aabove the figures and artifices. Here must be an intimate marriage of form and matter, and there must be the glow of personality। অর্থাৎ আধার এবং আধেয়কে মেলাতে হবে এবং এই পারস্পরিক অবজেকটিভ কোরিলেটিভ থেকেই গড়ে উঠবে শ্রেষ্ঠ কবিতাটি।এই বিষয়াশ্রয়তা ক্রমপ্রলম্বিত হয়েই কি রবীন্দ্রনাথের ছবিঘর কিম্বা জীবনানন্দের আকীর্ণ মৃত্যুচেতনার অনুধ্যাননা!  দিনলিপি থেকে ধূলোর সংসার থেকে পাঠকের শ্রুতিসিদ্ধি করছেন তারও পরবর্তী কবিরা।পাশ্চাত্যেও যেন এই একই ছবি, পুনরাবৃত্তির আর্দ্রতায় পাঠকচৈতন্যকে ভেজানোর কাব্যঐতিহ্য। এজরা পাউণ্ডের নেগেটিভ ক্যাপাবেলিটি কিম্বা এলিয়টের ইউনাইটেড সেনসিবিলিটও একই খণ্ড লিরিকের সাক্ষ্য দেয়।প্রিয়তম পথের থেকেই একই স্বপ্নফেরীর। তবে কি শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লেখা হয়ে গেছে? আসলে শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে কিছু নেই। কবিতা হল শব্দের স্বভাব। অনেকটা সেই আসবাবহীন খোয়াবসংগীতের ভেতর ছাপছোপহীন ঘুঙুরের মত। পায়ে নুপুর আটকে যে বেজে ওঠে সে বাজনায় আছে ধারাবাহিকতা  সে বাজনায় নেই আস্পর্ধা, সে বাজনায় নেই স্বর তৈরী করা , সে কেবল সর্তক করছে পরিমিত করছে, সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আসার কথা বলছে না, গলানো সপ্তর্ষির দিকে খুব বড় একটা আকাশ শিকার করার কথা বলছে না , আমি কেবল নিত্য জীবন থেকে বাসনা থেকে অনিত্য ছোটাছুটি নিলাম আর তাকে কিছু সিঞ্চিত মনপাখি দিলাম কিছু জীবনফসল দিলাম, কেবল আধার এবং আধেয়ের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠল শ্রেষ্ঠ কবিতাটি! না তা উত্তাপ পেলো না, তা আসঙ্গ হলোনা। শব্দকে মুক্ত করতে হবে। সজ্ঞায়িত কলকবজা ফেলে দিয়ে ঝুমঝুমির ভেতর কবি খুঁজবে তাঁর একূল ওকূল তাঁর নথিপত্র তাঁর পূর্ণতার সংজ্ঞা!

  অজস্র রচনা, অজস্র ঋতু, অজস্র মানুষ এই অজস্রতা এই বিচ্ছিন্নতাই কবির সাধনা।কোথায় ফুটে ওঠে কবিতাটি! এই বনানী এই বিভার মধ্য দিয়েই তো চলেছি বাতাসনির্ভর হয়ে জলনির্ভর হয়ে; আসা যাওয়ার পথে কত কিছু! কত ঘরে ফেরার আলো, কত অরক্ষনীয়া অশ্রুত অন্ধকার,সীমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রচ্ছায়ায় মিশে যাওয়া নিঁখোজ অন্তগমন;কাছে কে? ভীড়ের হৃদয় ছেড়ে কে সহাবস্থানে! কেবল পেরোই! শব্দ থেকে চিত্র থেকে মেঘাবরণ রসের খোঁজে ফিরে দেখতে চাই অচেতনার রসায়ণ; সে ঠিক কোথায়? কত্দূর গেছে? ঘুমিয়ে পড়ার মত সেও কি আকাশের সাথে মিশে যাবে, আকাশের রং নেবে? নাকি মানবমানবীর পাশে এসে বালিশ বদল করবে দীর্ঘময় একটা কৃষ্ণপথ! সব চলার ভেতর আমাদের এই স্বল্প বেজে ওঠা,বীতভাষ মহাকালের ভগ্নাংশ কুড়িয়ে পেরিয়ে আসা শাস্ত্রীয় স্বীকারোক্তির কাছে।একে কি অতিক্রম বলে? মানে এই বাহিরের আকাশ হতে ভেতরের অন্তরীক্ষ! এই জাগরনের ভেতর এই ধূলাউড়ির ভেতর এই যে হাটখোলা মেঘমায়া, সুনীল প্রান্তিকের ভেতর এই যে একজোড়া আদানপ্রদান ধরা যাক সে হেসে উঠল কবিতা নামে; এবার এখান থেকে কোথায় যাবেন? প্রত্যাখানের আলোচনায় নাকি নন্দনতত্ত্বে!কবিতার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল কবিতার অনুবর্তণ, ইমপসিবল অরিজিনালের কাছে তাঁর স্বজ্ঞার জবাবদিহি, তার প্লাজমের পরিসংখ্যান গোনা আর আমরা সুতিকাগৃহের থেকে স্মৃতিকে ভাসিয়ে দিলাম অসার সেজে ওঠার দিকে।তাগিদ, উপাদান,মনঃসমীক্ষা প্রায় সবকিছু নিয়েই বিক্রেতা এলো কবিতা কিনতে,কেউ প্রশ্ন করল না , কারুকে প্রশ্ন করা হলনা কারন সেখানে কবি নেই সে কেবল দ্রষ্টার পেছন পেছন শুঁড় দোলায় পোড়াঘরের ছবির প্রত্যাশায়,সে বীজগণিত নিয়ে কথা বলে বিযুক্তি ছেড়ে, সে বিশ্লেষণ করে অর্ঘ্যের থালা নিয়ে সে বিষয় করে না ফুলের  ইশারার। অথচ একটা সহজিয়া অস্বীকারকে যদি আমরা মনোজগতের পাথুরে জমিতে সংক্রামিত করতে পারি, কান পেতে থাকি একটা শায়িত অলক্ষিতের দিকে আর শোনার চেষ্টা করি জননক্ষম বিভাজনের, তবে কি আমায় টান দেবে জুঁই চাঁপার মত কেবল কিছু সহজ সাজের গল্প? একটা অ্যাবসুলিউট ইন্টোরেগেশন! একটা বিকল্পের পরিবৃত্তি!খসে পড়া শব্দ তার অনুচ্চারনের ঘাড় উঁচু করে বলবে এই নির্মল জন্মের আগে শেষ মদ নিয়ে আমিই এসেছি নিরঞ্জনের নেশায় -দ্বিতীয়ার নির্মাণে!!....যতবারই শ্যাওলা জড়িয়ে ফিরে আসছি ছককাটা সংকল্পের দিকে ততবারই কবিতা আমাকে দখল করছে, রক্তের মধ্যে মিশিয়ে দিচ্ছে সাত সাতটা রং। কবিতায় যুক্তি নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা যায় বলে মনে হয়না, গোনা যায় না আরোহণের আলো,ধরা যায়না অবরোহনের আরবী ঘোড়া। শব্দের কাছে এসে প্রশ্ন করা যেতে পারে আঁধার কত? গৃহসম থেকে কবি কেবল টানা ছুটি নিতে পারে ভ্রমনের দিকে কেবল একটা অশ্রাব্যের দিকে।এই আঁধার প্রতারক নয়, এই আঁধার প্রার্থণার যা গুটি ভেঙে নিয়ে যাবে আকাশগঙ্গার দিকে; এই যে কুঁড়ি ,তার পোশাক তার চোখ ,বিবিধ জাড্যে মোড়া তার প্রতিটা সাংখ্যিক দীর্ঘতা সেও আসলে ফুলের কাছেই নিয়ে চলেছে তার অপ্রমাণ। ওই যে সুন্দর, চোখ টিপে হাসল , আসলে সে নিয়মতন্ত্রের কয়েকটি পাখির দিকে ছুড়ে দিল আরও কিছুক্ষণ থাকা আরও কিছুটা অনন্ত মুক্তির নিশ্চয়তা।

           নতুনকে দেখতে হলে নতুনের মুখোমুখি হতে হয়। নতুনকে পেরোতে হয় শব্দের ভ্রমিল নিরাপত্তা ছেড়ে। বিষয় নয়, অপ্রত্যক্ষিত বাস্তবকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে বিশেষ স্বনে, দেখার আনন্দে। আতুড়ের ঝুলকালি মাখা যে কল্পমূর্তিটা প্রতিদিনের তাকেই ছিন্নভিন্ন করবে কবি,বহুধা মৌলের ভেতর খুঁজবে তৃতীয় মৌলটি।দৃশ্য হল আসলে কবিতার জন্মের পূর্বভাগ,যা জন্মের পরই প্রকৃত কবির হাতে খন্ডিত হবে, কিন্তু এই বিভাজন কেবল সামগ্রিকতায় বন্দী থাকলে কবিতার মুক্তি অসম্ভব; বেরোনোর দরজা খোঁজার আগে সত্যানুসন্ধানের আগে চিত্রকরের মত কবিকেও খুঁজে নিতে হবে বস্তুজগতের ছলাকলা আর তাকে অনির্ণয়ে অসংখ্যে অনুদিত করে নিতে হবে। বুনিয়াদি কোলাহলের ভেতরেই সাজিয়ে নিতে হবে ছোট ছোট ছায়ার বীক্ষন আর  ছায়াহীন দাহ নিয়ে খেলতে বসবে কবি; ধরা যাক নদী মানে ছলাৎ ছলাৎ.. অথচ নদী  তো সেখানে নদীর একার নয়, নদী জলেরও , নীল নীল প্যাস্টেলে বুলিয়ে দিলেই নদী হেসে উঠবে সুস্মিত চোখে আবার স্থিতপ্রজ্ঞ ঢেউগুলোকে দেখেই তার পাবে তৃষ্ণা সে তখন অভিমানের রং। শীত শীত হাওয়ার কাছে নদী যা সমুদ্রপাখির কাছে নদী তো তা নয়। কখনও ছিটকে পড়ল কখনও ঘন হয়ে যেতে যেতে ডুবিয়ে দিল। বস্তুগত সমস্ত দৃশ্যর মধ্যেই এমন বহুধা সিঁড়ি আছে যা প্রকৃত কবি ছাড়া আর কারোও যাওয়া হয়ে ওঠে না।  কবিতা তো এই দৃশ্যকল্পের মধ্যেই অন্তহীন দৃশ্যের দাপাদাপি, কোন কোন দৃশ্য তার জন্মান্ধ দণ্ডাজ্ঞা ফেলে কবির লুকোনো হাতগুলিকে কেবল আঁকড়ে ধরে। তারপর? ওই যে নবান্নের গন্ধে ভরে ওঠে হাতের গন্তব্য আর গন্তব্য ছুঁয়ে দিয়ে একা হয়ে যায় শব্দ।যতই সে ছড়িয়ে যেতে থাকবে ততই সে অনুপম , উপহার দেবে অস্ফুট তিতিক্ষা। ঠিক এখান থেকে শব্দকে আর প্রত্যক্ষ করতে  পারব না, চিহ্নিত করতে পারব না তাকে কারন সে তখন এক অপরীকরনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যুক্তি ও আবেগ থেকে ছিটকে গেছে সৃজনের অধিকার নিয়ে।এখান থেকেই কবিতা একটা মন্ত্রগুপ্তি, একটা মাঝারি উচ্চতার ঘরের অন্ধকার, একটা দারুন জৈব গন্ধ কিম্বা একটা পেলব ব্যথার মত গ্রহন ছেড়ে নির্দেশ ছেড়ে মিশে যাচ্ছে আরও  এক অগম্য শূণ্যতায়।প্রকৃত কবিতা এবার বিশুদ্ধ। চারপুরুষের দোতারা নিয়ে সে এবার বিবর্জিত হতে এসেছে। তাকে আর সংকল্পিত করা যাবে না। কবি ফিরে গেলেন নেশাগ্রস্ত তর্পণে, তীব্র হুইসেলে বাজিয়ে গেলেন ফেরার কথা আর দরজার এপারে ছেড়ে গেলেন পাঠককে যার হাতে এখন সেই অস্পষ্ট কপাটগুলো খোলার খেলা যেখান থেকে কবি নিজেও জানলেন না ঠিক কতদূর চলে এলেন তিনি পাঠকও  জানবে না আরও কতদূর যেতে হবে একটি প্রকৃত কবিতার খোঁজে।

Nothing happens, Nobody comes, Nobody goes. It is awfulওয়েটিং ফর গোদতের ভবঘুরে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগনের মত এ খোঁজ এ অপেক্ষা যেন কোনো এক ইনোসেন্স সাফারিংসের মধ্যেই মধুর হয়ে থাকে। শব্দকে পেছনে ঠেলে দিয়ে কবিতার এই  চোর চোর বুড়ি বুড়ি থেকে তৃতীয় পৃথিবীর দিকে হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় চুরি হবার মত  কোন বিষাদই বোধ হয় কবির নেই;একটু হাওয়া দিতেই একটু গুঁড়ো জল দিতেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রনরেখা পেরিয়ে যায় আমাদের সব নাগাল -বিস্তর সব ছোটাছুটি।ঠিক যেন হলুদ আর কালো রং নিয়ে কেউ আসে হাত ধরে স্থায়ী বনপর্বে নিয়ে যেতে,যেখানে নিঁখুত সেজেছে নিরাময়ের কথা।সব নিরাময়ই আসলে অসুখের নিরাভরনে আসে; কবিতা তো নিরাময় ,যে খুঁজে পেতে চাইছে সেই অসুখকে যা দেরাজ আলমারী থেকে টেনে এনেছেন কবি যা ঘুম থেকে উঠেই উৎসের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন কবি।
বলেছি, এভাবে নয়, দৃশ্যের নিকটে এনে দিয়ে
সকলে বিদায় নাও; পিপাসার্ত তুলি আছে হাতে,
চিত্রণ সফল হলে শুনে নিও যুগল ঘোষণা।
অথবা কেবল তুমি লিপ্ত হলে সমাধান হয়।
একটি বিশুদ্ধ কবিতার কাছে এর চেয়ে বেশী কি চাইবে কবি? এই দৃশ্যের ভেতর ছায়ার ভেতরই তো তাকে রেখে যাওয়া হয়েছে প্রচ্ছায়া নির্মানে,আত্মময় উত্তরাধিকার নির্মানে। প্রচুর শিশুতরু দিয়ে সাজিয়ে রাখা বিশুদ্ধ প্রবাহমানে মাঝে মাঝে এসে  দাঁড়াই কয়েকটা স্বরের টূকরো নিয়ে শব্দের টূকরো নিয়ে আলোর টুকরো নিয়ে অসনাক্তের টুকরো নিয়ে। চেতনার ম্যাগেট নিয়ে।এসে দাঁড়াই সুপরিকল্পিত সুচিন্তিত মানুষের ভীড়ে, সমর্পিত চামড়ার ধৈবতে, এরা আসলে আমাকে নক্ষত্র দেখায়, চেনায় পূর্নতার দিকে ঝরে যাওয়া ফুলটির সুলভ দোলা; স্মৃতি নামের টিলায় দাগ দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি আসঙ্গ অফুরন্তে। আমার বেড়ে ওঠার ধরনটা পাশ ফিরে শোয় আমার বেড়ে ওঠার ধরনটা নির্দেশহীন ডাল নাড়াতে ওঠে ত্রিমাত্রিক সিঁড়ীঘরের মত, পৃথিবী খুলে খুলে কিভাবে যে লাফ দিই বৃষ্টিদেশে কীভাবে যে দাঁত দিয়ে চেপে ধরি উদাসী হাওয়ার খুনসুটি তা বোঝাই দায়, হেঁটে যাওয়ার মানসতা নিয়ে আমাকে প্রত্যক্ষ করছে সে, মন্থন করছে,নাগাড়ে যেতে যেতে জানতেই পারি না সম্ভাবনার ভেতর আবহমানকে ছুঁয়েছি কখন! আবহমান থেকে ফিরে আসছি প্রবাহমানে; ফল দিতে শুরু করছে আমার অনন্তকালীন গাছ নাকি গাছের আগেই ফুল সেজে দিচ্ছি বাগান খুঁজতে গিয়ে! কখন গড়িয়ে নেমেছি চাকার বাতাস ধরে! কেবল ক্যানভাসময় হেঁটে এসে দেখি কি গভীরভাবে প্রতিবেশী স্বাস্থ্য লেগে আছে আমারই গৃহহীণ প্রতিবেদনে। ……সেই কি কবিতা? হঠাৎ একদিন চিত হয়ে পড়ে যেতেই নদীটির কোরাস হয়ে গেল? তামাম পৃথিবীভূমি থেকে গাছের জগৎ নিয়ে বাজতে বাজতে উঠে এল স্বাক্ষরহীন বন্দিশে! শব্দরা ফিরবে না, কাঁধে হাত রেখে বলবে না এই মায়াক্রসিং এই আছি;সে যে স্মরনযোগ্যতার বাইরে, বিন্যাসের বাইরে, ফেরার বাইরে; ঢাকনা ফুটো করে সে কেবল অবাধ্যই হয়েছে অসম্পূর্ণতার দিকে। এই ধেনুবর্ণের জগতে কবিতা আজও আমার কাছে পাখির ডাকের মতই রয়ে গেল অস্পষ্ট, কোলাহলে কয়েকটা স্বাপ্নিকের স্বরই কেবল আত্মীয়তা নিয়ে থাকল দাঁড়িয়ে । কেন যে  লিখি কেন যে কবিতার দিকে চলে যাই দেউড়ি পেরিয়ে তার সুস্পষ্টতা আজও  প্রকারে ইঙ্গিতে আড়ালেই রয়ে গেছে, চেপে ধরতেই হবে সংক্রামিত হতেই হবে এমন কোন  মুকুলিত উচ্চারণেরও যে প্রয়োজন বোধ করেছি তেমনটাও নয়। আসলে একটা বিস্ময়ের অপ্রাকৃত দিয়ালীপোকা সর্বত্রই চেনা হয়ে আছে,ভেসে যেতে যেতে কেবল ঘুমের ভেতর ঢুকে পড়ছে আর বৃষ্টির ধানাইপানাই নিয়ে তৈরী করছে শব্দের কুশলতা কিম্বা হিমগহন ফাগ ছুঁড়ে দিচ্ছে সেই উড়ে যাওয়ার দিকে। প্রেমসঞ্জাত কোন আনুভূমিক গাঢ়তায় নয়,সমধানে পৌঁছোনো নয়,তাকে তো খুঁজে চলেছি চলনসারি স্পন্দনে, চুঁইয়ে পড়া রঙে, বিধুবনে ,জীবনের অন্যান্যে……




*****************************************************