আলোর দানায় ওড়ে আমার না-এর হেসে ওঠা
একেকটা
কবিতায় একেকটা বাড়ি থাকে। অনেকরকম মানুষ আমাদের চারপাশে,
আর
তাদের হরেক কিসিমের জীবনযাপন। জীবনভর একই বাড়িতে থেকে যান যারা, তাদের স্মৃতিপট
একরকমের। আর যারা মাঝেমধ্যে বাড়ি বদল করেন, তাদের স্মৃতিশিকেয় অনেকরকম বাড়ি জমে
ওঠে। একেকটা ছেড়ে আসা বাড়ি যত পুরনো হয়, পূর্বজন্মের মিথ তার গায়ে চাদরের রোঁয়ার মত ফুটে উঠতে থাকে। একটা সময় মনে
পড়া না পড়ার ঘোর কুয়াশায় সে তার অবয়ব হারিয়ে অস্পষ্ট শীতকালের মত দাঁড়িয়ে থাকে।
শুধু স্পেস মুভিগুলোতে যেমন দেখায়, ভিনগ্রহী সঙ্কেতবার্তা পার্থিব রাডারে
এই-ধরা-দেয়-আবার-হারায়, তেমনই সে, হঠাৎ পাঠায় দু এক মুহূর্তের সাইনেস্থেসিয়া। যেন
বোঝায় তোমার এই খুব জ্যান্ত বর্তমানে আসার পথে দূরে কোথাও দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছো
তাদের আর কথা দিয়ে রেখে ভুলে গেছো। কিংবা শুইয়ে দিয়ে এসেছো কোনো টেবিলে ক্লোরোফর্ম
দিয়ে, তোমার সচেতনতায় সে হানা দিয়ে মাছের কাঁটার মত পাপবোধ জাগিয়ে তুলেছে।
যতবার বাড়ি বদলে (এইখানে একটা ধন্দ আছে;
ভাড়ায় নেওয়া বাসস্থান কি কখনই সত্যি বাড়ি হয়ে ওঠে? যখন মনের কোণায় পড়ে থাকে এই
তথ্য যে এখান থেকে একদিন না একদিন বিদায় নিতেই হবে! তবে কি একে ‘বাসা’ বলাই
শ্রেয়?) নতুন জায়গায় উঠেছি, প্রায় প্রত্যেকটি বাসা’তেই, হয় আয়নায় নয়তো দেওয়ালের
কোনো কোণে দেখেছি একটা টিপ আটকে রয়েছে। আর তা থেকে অবশ্যম্ভাবী ভাবনাচারা। কেমন
ছিলেন এই টিপের অধিকারিণী? মধ্যবয়স্কা? তরুণী? গোছগাছ করার তাড়ায় শেষমুহূর্তে তার
নজর এড়িয়ে থেকে গেছে সে? নাকি অনেকদিনই কপালের ওম থেকে বিরত রয়েছে টিপটা? ভাবতে
ইচ্ছে করে, কেউ হয়ত ইচ্ছে করেই রেখে গেছেন এই টিপটাকে সঙ্কেতবার্ত্তার মত। চিহ্ন
রেখে গেছেন, যাতে তার স্মৃতি কিছুটা লেগে থাকে, কিছুটা তিনিও। আমিও কি রেখে এসেছি
এরকম কিছু ফেলে আসা ঘরগুলোয়? আমাদের দাম্পত্যে টিপ নেই। কিন্তু অন্য কোনো কিছু?
হয়তো ঝগড়ার দাগ, ফুটন্ত তেলের চিহ্ন, হয়ত নিঃশ্বাসবাষ্প। কে জানে!
এখনও অবধি জামশেদপুর ভাবলে মনের চোখে
ইন্দ্রনীলের তিনতলা বাড়িটা ভেসে আসে। আমি তো জানতামই না যে সেটা অস্থায়ী, ভাড়ায়
নেওয়া! প্রথমেই যা চোখ এবং মন টেনেছিল তা হল গ্রাউন্ড ফ্লোর এর নগ্ন হলঘর, মানে
তার আসবাবহীনতা। গান গাইলে দারুণ একটা রণণ হয়। ইন্দ্রকে বলেছি, শুধু এই ঘরটায় গলা
খুলে গান গাইবার জন্যই প্রভূত ট্রেন ঠেঙিয়ে জামশেদপুর আসা যায়। সেদিন, যা আসলে
রাতভর, রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে আমরা লালনে চলে গেলাম। বস্তুত সেই আড্ডা থেকেই
আমার লালনসাম্রাজ্যে প্রকৃত প্রবেশ। পরে যখন যাই আবার, দেখি ইন্দ্রনীলের সময় ওপরের
তলায় উঠে গেছে। ফলে প্রথমবারটি অনন্য হয়েই রইল। সে জানায় যে সে আসলে
আত্মহত্যাপ্রবণতা এড়াতে চেয়েছে। ফাঁকা ঘরে তাহলে প্ররোচনা থাকে?
ইন্দ্রনীল ঘোষ এখন আর জামশেদপুরে থাকে না।
সেই বাড়ি সে ছেড়ে দিয়েছে। তার ভাগলপুরের নিবাসটি কেমন জানিনা। তবে সে যেমন সেই
পেল্লায় গেটওয়ালা বাড়িটায় ছিল, বাড়িটাও ছিল না কি ইন্দ্রনীলের ভেতর? হয়ত দুজনেই
মনে করছে একে অন্যকে। অভ্যেসের ঘর পালটে যাওয়ায়, ইন্দ্র’র লেখাও কি পালটে যাচ্ছে
তবে?
( ২ )
লেখাটা
এইখানে শেষ হয়ে যেতে পারত। এই কবির আরো পুরনো একটা ঘরের পুরনো একটা লেখার কথা মনে
পড়ে গেল। এই আপাত নিরীহ কবিতাটা সম্পর্কে আমার নিজস্ব পাঠ-অনুভূতি লিখে রেখেছিলাম
অনেককাল আগে। আমার ঘরও তখন অন্য ছিল। পূর্বনির্দিষ্টতাকে তেমন একটা পাত্তা না
দিলেও দেখলাম, সেই লেখাটা দারুণ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লো আজ।
আসলে, আমিও এক কুয়াশার ছলবারান্দায়।
স্বমেহনের আড়াল খুঁজছি।
আলোর
দানায় ওড়ে আমার না-এর হেসে ওঠা
থেমে
উঠবার শিল্প হাসছে আলোর অণুকানে-
পুরোনো
কাঠের স্নেহ,পুরোনো কাঠের মনিঘোর
আসবাব
হতে হতে হঠাৎই হেসেছে
হাসির
মধ্যে কোনো আঙুলের ছাপ নড়ে কিনা
দুটো
ছাপ পাশাপাশি ‘ভালো আছো’ প্রশ্ন করে কিনা
বাড়িটা
এসব খোঁজে
আসবাবে
ভ’রে উঠে বাড়িও একলা হতে চায় ...
(হাইওয়েঃ৫ । রাত্রে ডেকো
না,প্লিজ । ইন্দ্রনীল ঘোষ)
ঠিক কখন প্রিয় হয়ে ওঠে
একটি কবিতা? যখন তার মধ্য থেকে আমার লেখার প্রাণকণা জন্মাতে দেখি? আমিই এটা লিখতে
চেয়েছি, মনে হয়? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থস্তর বদলাতে থাকে? অনেকটা, অনেকটাই। অনেক
কবিতার সঙ্গে অনেকদিন বাস করতে করতে মনে হয়, কবির অবজার্ভেশন যদি ভীষণরকম মৌলিক ও
শক্তিমান হয় তাহলে তার ক্ষয় নেই। সে ফুটে বেরোবেই। প্রকাশের নিজস্ব অনন্যতা তৈরি
করে নেবে। ইন্দ্রনীল অত্যন্ত ভাষাসচেতন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাপ্রাণ একজন কবি। নিজের
কাব্যভাষার কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘর গড়ে তুলে সেখানে নিশ্চিন্তে আটকা পড়তে সে চায়নি।
কবিতা থেকে কবিতান্তরে, সিরিজ থেকে অন্য সিরিজে, সে বারবার ছোটোবড়ো বদল এনেছে। আর
তার ভাষাব্যবহার, রসবোধ, পরিচিত মোটিফের ট্রেডমার্ক ছাড়িয়েও আমার কাছে প্রিয় হয়ে
উঠেছে তার অবজার্ভেশনের ছায়াময়তা। একটি কবিতার শব্দ, বাক্য, যতি টিপে টিপে দুধ বার
করে বিশ্লেষণের পাত্রে রাখায় আমার তুমুল অসমর্থন। শুধু দুই একটি উল্লেখে আমি সরে
যাবো।
এই কবিতাটি পাঁচটা কবিতার এক সিরিজের
শেষতম। ফলতঃ শিরোনাম তেমনভাবে নেই। ফলতঃ আরো মুক্ত। এই কবিতার একটা বিষয়লগ্নতা
আছে। আপাত যুক্তিশৃঙ্খলাও। ইন্দ্রনীল ‘ফার্ষ্ট পার্সন’ কে নানানভাবে স্থাপন করে
তার লেখায়। প্রথম লাইনে তার সামান্যই ছোঁয়া। যেন হাইওয়ে ধরে এক মিছিলপ্রায় গতির
শেষ ও বিলীয়মান চরিত্রটি। পূর্ব-পরের ‘ইন্দ্র’, ‘দীঘা’, ‘জুন’, ‘জুলাই’ ইত্যাদি
প্রপার নাউন নেই। দুইস্তবকের এই মিত কবিতায় ‘অণুকান’ ও ‘মনিঘোর’ ছাড়া নেই কোনো জোড়
কিংবা নব্যশব্দ। আলো-র মোটিফটি আলোর মতোই স্বচ্ছ ও যাতায়াতক্ষম হয়ে ছড়িয়ে থাকে
কবিতার শুরুতে। পুরনো কাঠের স্নেহ – কবিতাটাকে মাটিতে নামায়। অবয়ব দেয়। পুরনো
কাঠের মনিঘোর- আবার তাকে অস্বচ্ছও করে। একটা আবহ অনেকখানি প্রত্নগন্ধ নিয়ে জমে
উঠতে থাকে। আঙুলের ছাপের পারস্পরিক কুশলজিজ্ঞাসায় এই রহস্যে যেন মানুষের রঙ এসে
লাগে। আর জিজ্ঞাসাচিহ্ন ব্যতিরেকে কোটেশন মার্কের মধ্যে ‘ভালো আছো’-র উপস্থাপনা-
কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ উক্তিপ্রয়োগের ট্রাডিশন থেকে সন্তর্পণ স্নিগ্ধতায় আস্তে
ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। ‘আসবাবে ভরে উঠে বাড়িও একলা হতে চায়’ – গভীর সংবেদন থেকে উঠে
আসা এক অবজার্ভেশন। আলো ও আসবাবপ্রসঙ্গের পর বাড়ির চরিত্রটি যুক্তিপরম্পরায়
স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। এতে তেমন কোনো চমক লাগে না। আর সেখানেই শেষলাইনে ওস্তাদের
মার ফলাবার অমোঘ প্রবণতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেয় কবি। শুরুতেই ‘আমি’কে উপস্থিত
করেও ইন্দ্রনীল পরের লাইনগুলোতে তাকে ক্রমশ ফিকে করতে থাকে। যেন জলরঙে আঁকার এক
পদ্ধতি। কবিতাটি নৈর্বক্তিক হতে হতেও এক সূক্ষ্ম আত্মরতিকে গায়ে টেনে রাখে। চোখে
লাগার মতো মারাত্মক কোনো মোচড় ছাড়াই; তার বিষয়ফ্রেম, অক্ষরবৃত্তীয় চাল, লিরিকধর্মীতা-
এই সমস্ত নিয়েই কবিতাটা প্রিয় হয়ে ওঠে ও নতুন বাতাস এনে দেয়।
( ৩ )
মাত্রই কয়েকদিন আগে, প্রিসাইডিং
অফিসার হিসেবে ভোট নিতে যেতে হয়েছিল নন্দীগ্রামে। গ্রামে বেড়ে ওঠা আমার কাছেও সে
গ্রাম বড়োই রূপকথার মত প্রত্যন্ত ঠেকেছিল। যেখানে জলের উৎস কেবল পুকুর। নিবিড়
গাছপালা আর মাঠ দিয়ে ঘেরা এক শীর্ণ প্রাইমারি স্কুল ছিল আমার ভোটকেন্দ্র। বর্ষায়
যেমন হয়, সাপেরা ছিল দৃশ্যমান। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে মৃদু দু-একটা মানুষের গলা
অবচেতনের মত। সামান্য দু-এক গেরস্থালীর আওয়াজ সভ্যতাসংলগ্নতার বোধ বজায় রাখছিল। ইলেকট্রিসিটি
আছে বটে, তবে লোডশেডিংকেই তার প্রমাণ বলে ধরে নিতে হয়। সন্ধ্যে নামতে ছোটো বাহিনি
সমেত এলেন স্থানীয় নেতারা, আমার কি করা উচিৎ সে সম্পর্কে কিছু পরামর্শ ও অন্যথায়
কি হতে পারে তার চাপা হুমকি। শরীরে সাড় ফিরতে কিছুটা সময় লেগেছিল। সরাসরি এমন
প্রথম কিনা! দ্রুত নবপ্রযুক্ত ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকলাম। পরের দিন একতরফা
ভোট হল। চোখের সামনে এক মধ্যবয়স্ক ইলেকশন এজেন্টকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মেরে
বুথ থেকে বের করে দেওয়া হল। এক বৃদ্ধাকে দেখলাম ভোট দেওয়ার আগে পোলিং এজেন্টদের
বেঞ্চের দিকে একবার তাকালেন, তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও দেখতে পেলাম সেই নেতার
ঠান্ডা চাহনি, তারপর রীতিমতো কাঁপতে থাকলেন সেই বৃদ্ধা। নিরাপত্তা নেই। সরাসরি
ছাপ্পা না হওয়ায়, আগ বাড়িয়ে আমার কিছু করারও নেই। বুকে পাথর নিয়ে কাজ করে যেতে
লাগলাম। রাত ৯ টায় এই রাজনৈতিক প্রহসনটি মিটল। বুথঘর ছেড়ে এসে দাঁড়ালাম সেই
পুকুরের পাড়ে। আর সাপের ভয় করছেনা তখন। সাপ তো নেহাৎই প্রকৃতির জীব। সিগারেট
ধরালাম একটা। অজস্র তারায় স্পষ্ট আকাশ তখন আরও বিরাট। আমার কানে তখন মানুষের শব্দ
ক্ষীণ হয়ে আসছে। যেন জামাকাপড় খুলে ফেলতে চাইছি আমি। যেন আমি ছিঁড়ে ফেলব বুকে
ঝোলানো হাস্যকর এই আইডেনটিটি কার্ডটা। যেন তখন আমার কানে শুদ্ধ সুরে মন্ত্র দিলে
তখনই বিশ্বাসী হয়ে যাবো। আর তখন এই লাইনটা আমাকে দেখিয়ে দেয়ঃ ‘আলোর দানায় ওড়ে আমার
না-এর হেসে ওঠা’। বুঝতে পারি গোটা একটা কবিতা কক্ষণও থাকবেনা আমার জীবনে।